তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ডাইনি গল্পের মুল বিষয়বস্তু কি? (ডাইনি চরিত্র বিশ্লেষণ / সামাজিক কুসংস্কার / অনাথ বালিকার ট্রাজেডি)
ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা। আধুনিক যুগে এ শাখার সৃষ্টি হয়েছে এবং বর্তমানে এ শাখা সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা। এরপর বাংলা সাহিত্যে অনেক লেখক এসেছে। এদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭১) একজন অন্যতম লেখক। বাংলা ছোটগল্প রচনায় তিনি বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গল্পের সংখ্যা অনেক। এরমধ্যে ‘ডাইনী’ একটি অন্যতম গল্প। তারাশঙ্কর অধিকাংশ গল্পে সমাজের নিম্নেবর্গের মানুষের জীবনযন্ত্রণা উপস্থাপন করেছেন। নিম্নে ডাইনি গল্পের বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো-
তারাশঙ্কর সমাজসচেতন শিল্পী। তিনি সমকালীন সমাজে মানুষের শ্রেণিবিভাজন দেখতে পেয়েছেন । একই সমাজে একজন গাছতলায়, আবার একজন পাঁচতলায়। একজন দু’বেলার খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না, আবার আরেকজন অসংখ্য মানুষের খাবার মজুত করে রাখছে। সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য এতটাই প্রকট। তারাশঙ্কর এসব ব্যবধান দেখেছেন আর এগুলোকেই তাঁর ছোটগল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেছেন। চরিত্রগুলোও তিনি সমাজের প্রান্তিক মানুষ থেকে নির্বাচন করেছেন। তাঁর গল্পগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অধিকাংশ গল্পের নারী ও পুরুষ চরিত্র সমাজের নিচু তলার মানুষ। ‘ডাইনী’ গল্পের অনাথ বালিকা ডাইনী। সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের জীবনযন্ত্রণাকে তারাশঙ্কর তাঁর ছোটগল্পে উপস্থাপন করেছেন দক্ষতার সাথে।
ডাইনি গল্পের কাহিনি মতে জানা যায়, পাথরঘাটা গ্রামের অনাথ বালিকা ‘সরা’। এই বালিকার পিতামাতা নেই; তার পিতামাতা ডোম ছিল; এই ডোম বালিকা পথেপথে ভিক্ষা করে খাবার সংগ্রহ করতো। বালিকা ক্ষুধার্ত ছিল; তাই কাউকে খেতে দেখলেই সে লোলুভ দৃষ্টি নিয়ে খাবারের দিকে চেয়ে থাকতো। সাবিত্রী, সাবিত্রীর শাশুড়ি, হারুগোষসহ গ্রামের সবাই এই অনাথ বালিকাকে ‘ডাইনি’ বলে মনে করে এবং সব সময় নিজেদের সন্তানদের দূরে দূরে সরিয়ে রাখে। এমনকি ডাইনির সামনে বাচ্চাদের খাবার খেতে দেয় না। অনাথ বালিকা কোন বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে পারে না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা এই ডোম বালিকাকে দেখলে পালিয়ে যায়, কখনো কখনো কেঁদে ওঠে। সবাই তাকে ডাইনি বলে বিশ্বাস করে; ফলে ডাইনি মেয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বোলপুর শহরে যায় এবং এক ডোম পুরুষকে বিয়ে করে।
গ্রামের মানুষের কুসংস্কার ও লোকবিশ্বাসের মত এই ডোম মেয়ে এক সময়ে নিজেকে ডাইনি হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ফলে সে ডাইনি হয়ে ওঠে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দিকে নজর পড়লে বাচ্চাদের অপঘাতে মৃত্যু হতে লাগলো। অনাথ বালিকা নিজেকে ডাইনি হিসেবে দেখতে চায় না। সে মন্দিরে যায়, দেবির কাছে প্রার্থনা জানায়, দেবতা তাকে যেন ডাইনি থেকে একজন ভাল মানুষ বানিয়ে দেয়। সে স্নেহের দৃষ্টিতে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকাতে চায়। কিন্তু যেখানে দৃষ্টি পড়ে সেখানেই অঘটন ঘটে যায়। তাই ডোম বালিকা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে পূর্ব জন্মের কোন পাপের জন্য তার এই পরিণতি। তাছাড়া কোন এক সময়ে তার মধ্যে ভীষণ ক্রোধের জন্ম হয়। এখন ডাইনি সত্যি সত্যিই মানুষের রক্ত শোষণ করে। একদিন ডাইনির বাড়িতে এক যুবতী বৌ ছোট শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে পানি খেতে আসে। ডাইনির দৃষ্টি পড়ে ছেলেটির উপর। ডাইনি বলেÑ‘খেয়ে ফেললাম, ছেলেটারে খেয়ে ফেললাম রে । পালা, তুই ছেলে নিয়ে পালা বলছি।’ তারপর একদিন ডাইনি এক যুবক ছেলের দিকে প্রেমের দৃষ্টিতে তাকায় এবং বলে- ‘মর মর, তুই মর’। ছেলেটি মারা যায়। এইভাবে ডাইনির দৃষ্টিতে লোকের অপঘাতে মৃত্যু হতে থাকে। গল্পের শেষে দেখা যায়, ছাতি ফাটার মাঠে অপঘাতে একদিন ডাইনিরও মৃত্যু ঘটে। এইভাবে অনাথ ডোমবালিকার জীবনের করুণ সমাপ্তি ঘটে।
এই গল্পে কয়েকটি বিষয় আমরা দেখতে পাই। প্রথমত ডোমবালিকা অনাথ, অভাবের জন্য ক্ষুধার তাড়নায় সে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকতো। কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে ডাইনি বলায় কোন এক সময়ে মেয়েটি ডাইনি হয়ে যায়, মানুষের উপর তার কুনজর পড়ে। গ্রামের মানুষের অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের প্রতি লেখক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গ্রাম্য মানুষ একজন অনাথ বালিকাকে স্নেহে না দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়ে তাকে আস্তে আস্তে ডাইনি বানিয়ে তোলে। গল্পের শেষে অসহায়ভাবে এই বালিকার অপঘাতে মৃত্যু হয়। ডাইনি চরিত্রের বেদনাময় পরিসমাপ্তি এই গল্পে দেখা যাচ্ছে। মানসিকভাবে ডাইনি এক সময় মানুষের উপর ক্ষিপ্ত হয়। গল্পের সার্বিক কাহিনি ডাইনিকে নিয়ে সংঘটিত হয়েছে। লেখক এই সমস্ত কারণেই গল্পের নামকরণ করেছেন ‘ডাইনি’। বিষয়বস্তু নির্বাচন, চরিত্র গঠন, কাহিনি উপস্থাপনা সব কিছু মিলিয়ে ‘ডাইনি’ একটি শিল্পসফল ছোটগল্প। সমাজ বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে এই গল্পের কাহিনি সৃষ্টি হয়েছে।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায় একজন সমাজ সচেতন শিল্পী। তিনি সচেতনভাবে তাঁর গল্পে সমকালীন সমাজের অবহেলিত মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-বেদনাময় চিত্র তিনি উপস্থাপন করেছেন। ‘ডাইনি’ গল্পের ডাইনি চরিত্রটিকে তিনি সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জীবন্ত করে তুলেছেন। সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে বলা যায় যে, বিষয়বস্তু নির্বাচন, চরিত্র নির্মাণ, কাহিনি বর্ণনা সর্বোপরি উপস্থাপনাশৈলীতে তাঁর ‘ডাইনি’ গল্পটি বাংলা কথাসাহিত্যে সাহিত্যে বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছে।