জীবনানন্দ দাশের রুপসী বাংলায় আবহমান বাংলার অন্তরঙ্গ রুপ অসাধারণভাবে ধরা পড়েছে’-আলোচনা কর। (কবিমানস/প্রকৃতির বর্ণনা)
কল্পনা কবিতা নির্মাণের একটি উপাদান, তবে একমাত্র উপাদান নয়। কল্পনার সঙ্গে বান্তববোধ ও জীবনঘনিষ্ট আরও কিছু উপাদানের সমন্বয়ে ও সংযোগে ত্রিশের দশকের কবিরা কাব্যনির্মাণের একটি নতুন কাব্যান্দোলনে নিজেদেরকে মনোনিবেশ করলেন। এ কাবান্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ‘ঝরা পালক’। রুপসী বাংলা অন্যতম কাব্যগ্রন্থ। নিচে রুপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের আলোকে তাঁর কাব্যবৈশিষ্ট্য/কবিমানস আলোচনা করা হলো-
বলা হয়ে থাকে যে, জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির কবি, নির্জনতার কবি, রুপসী বাংলার কবি, শুদ্ধতম কবি- এ রকম আরও কত নতুন নতুন অভিধায় জীবনানন্দ দাশকে অভিহিত করা যায়। ইংরেজি ভাষার কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থকেও প্রকৃতির কবি অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় কম-বেশি প্রকৃতির উপস্থাপনা রয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামসহ সব লেখককে কম-বেশি প্রকৃতি প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের জীবনে প্রকৃতির প্রভাব ও তাঁর কাব্যে প্রকৃতির উপস্থাপনা জীবনানন্দ দাশকে সব কবি থেকে আলাদা করে রেখেছে। জীবনানন্দ দাশ বাংলার রুপে মুগ্ধ। এ মুগ্ধতা যতটা কাব্যিক তার চেয়ে বেশি আত্মিক। বাহ্যিক দৃষ্টির সাথে অন্তরদৃষ্টির সংযোগ সাধনে এক অনন্য মুগ্ধতা কবিকে সুখ-সোহাগে ভরিয়ে তোলে, কবি প্রকৃতিকে অবলোকন করেন, হৃদয়জাত মোহময় মুগ্ধতায় নিজেকে ভাবের সাগরে ভাসিয়ে দেন; আর কাতর দৃষ্টিতে ঝরা পালক দেখে মোহবিষ্ট হোন।
কবি এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন, এ মাটির আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছেন। তিনি ‘বাংলার মুখ’ দেখেছেন, আর পৃথিবীর রূপ খুঁজতে যান না। আজীবন থেকে যেতে চান এ বাংলার বুকে। এমনকি সবাই যদি তাকে একাকী ফেলেও যায়, তবুও। আর তাই তিনি সহজেই তার সতীর্থদের উদ্দেশ্যে সহজেই এভাবে বলতে পারেন-
তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে
রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে।
জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতির স্বরুপ তাঁর কল্পনার জগতকে অতিক্রম করে বাস্তবের জগতে নেমে আসে। কবির প্রকৃতির সৌন্দর্য আছে, তা কবিকে এক তন্ময় সুখ-সৌন্দর্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর কবি এ ভাবে নিজেকে ভাসিয়ে দিতেও পছন্দ করেন। তার প্রকৃতির অপরূপ শোভা কোন নামী-দামী জায়গা যেমন সুন্দরবন, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন বা রাঙ্গামাটির পাহাড়ি কোন শোভা নয়; একান্তই কবির পারিপার্শ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানাবিধ অতিব তুচ্ছ জিনিস। যেমন কলমিলতা, কলমিলতার ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা, সরপুঁটি, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত, পায়ে দলা মুথা ঘাস, লাল বটফল; তবে এ গুলোই কবিদৃষ্টিতে হয়ে ওঠে অসাধারণ।
পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদাসরপুঁটিদের
মৃদঘ্রাণ, কিশোরীর চালধোয়া ভিজে হাত-শীত হাত খানা,
কিশোরীর পায়ে দলা মুথা ঘাস,-লাল লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা- এরই মাঝে বাংলার প্রাণ;
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।
বাংলাদেশের প্রকৃতি কবিমানসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। ভেরেন্ডাফুল, মুথাঘাস, পরথুপী মধুকূপী ঘাস, করবীঘাস, কাটা ধান, ধানের খড়, বাসমতী চাল, বাংলার তৃণ, ডিঙা নৌকা, রাঙা লিচু,আম-কাঁঠালের বাগান- এরকম পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রকৃতির অনেক কিছুই জীবনানন্দ দাশের কবিমানস ও কবিসত্তাকে পরিপুষ্ট করেছে। তাই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও নিবিড়িতা এক অসাধারণ সংযোগসেতু নির্মাণ করে। তাই কবি বার বার ফিরে আসতে চান এই বাংলায়।
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
ঘয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশায় বুক ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়;
জীবনানন্দ দাশের কবিমানস সম্পর্কে কবি ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আলী আহসান বলছেন-‘জীবনানন্দ দাশ প্রধানত প্রকৃতির কবি।’ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কে সম্বন্ধে প্রাবন্ধিক আরও বলছেন যে-‘জীবনানন্দ দাশ তাঁর সরল সত্তার সঙ্গে পল্লী প্রকৃতিকে ওতপ্রোত করেছিলেন। মাটির গন্ধ, বাতাসে পাতা নড়ার শব্দ, ফলভারে আনত গাছের ডালের সজীবতা, আকাশে-নদীতে-প্রান্তরে বিচিত্র বর্ণের সমারোহ কবির অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার হয়েছে। শরৎকালের পরিচ্ছন্নতা এবং হেমন্তে শস্যসম্ভারের বর্ণবিন্যাস কবির সর্ব সময়ের আশ্রয়। জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি অসম্ভব মমতাময়। ‘দুধে-আদ্র’ মাতার স্তনের মতো কমল এবং নবনীত। ভেবেছেন গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দকে, পায়ের তলার ভেজা মাটিকে, গাছের ডালের শালিক বা চড়–ই পাখিকে। জীবনানন্দ দাশ পল্লীপ্রকৃতির মধ্যে আপন চিত্তের নিভৃত লোকের আর্তিকে পেয়েছিলেন।’
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।