রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে গীতিধর্ম-আলোচনা কর।
বাংলা ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তাঁর প্রথম গল্প ‘ভিক্ষারী’, ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। অতপর ১৮৮৪ থেকে ১৮৮৫ তে ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’ ও ‘মুকুট’ প্রকাশিত হলেও ১৮৯০ সালে ‘হিতবাদী’ প্রত্রিকায় প্রকাশিত ‘দেনা পাওনা’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম সার্থক ছোট গল্প। এই ‘দেনাপাওনা’ গল্পটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্প । রবীরন্দ্রনাথ সর্বোমোট ১১৯ টি ছোটগল্প রচনা করেছেন। জমিদারী দেখাশোনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর দেখা বাস্তব সমাজে মানবজীবনের নানা চিত্র ছোটগল্পে উঠে এসেছে। এই ফল স্বরুপ সৃষ্টি হয়েছে তাঁর এক একটি সার্থক ছোটগল্প। কোন কোন সমালোচক রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে গীতিধর্মী বলেছেন-বিষয়টি নিম্ন আলোচনা করা হলো-
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিচিত্র বিষয় নিয়ে ছোটগল্প লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের বিষয় বৈচিত্র সম্পর্কে শিশিরকুমার দাস তার ‘বাংলা ছোটগল্প’ শির্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের বিষয়বৈচিত্র অসাধারণ। তিনি শহর নিয়ে লিখেছেন, গ্রাম নিয়ে লিখেছেন। তাঁর গল্পে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বার বার এসেছে।’ তাঁর গল্পগুলোকে নানা ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন প্রেমের গল্প, সামাজিক গল্প, অতিপ্রাকৃত গল্প, প্রকৃতি ও মানব সম্পর্কিত গল্প। তবে যেভাবে যে বিষয় নিয়েই গল্প লেখা হোক, তাতে প্রকৃতি ও মানবের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক তার গল্পে দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি প্রেমিক কবি প্রকৃতিকে তিনি ভালোবাসেন। তিনি দেশকে ভালোবাসেন, তাই প্রকৃতি ও দেশ তার গল্পে অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। গ্রামের ছোটখাট ঘটনাগুলো, ভাঙ্গাচোরা ঘাট, নদী তীরের বালুমাটি ঝরে পড়া, ন্যাটটো ছেলের ছাগল চরানো, ডাঙ্গায় জেলেদের জাল শুকানো, নদীর পাড়ে ধস নামা এমনই আরো কত কী। এ সব কোন কিছুই তাঁর চোখে এড়ায় না। এই সব ছোটখাট আর তুচ্ছ বিষয়কে অবলম্বন করে তিনি অসাধারণ সব গল্প রচনা করেছেন।
প্রকৃতির সত্যের সাথে মানবসত্যের যে নিবিড় সম্পর্ক সেটিই তিনি ছোটগল্পে কবিত্ব রস দিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। এ জন্য কোন কোন সমালোচক রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ভেতরে গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের কিছু গল্প আলোচনা করে দেখা যাক। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রতনের সাথে পোস্টমাস্টারের যে মানবিক সম্পর্ক তা মানবিক। প্রকৃতির প্রভাবে রতন ও পোস্টমাস্টারের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন ঘটে বিশেষ করে রতন চরিত্রের মানসিক পরিবর্তন আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়, ক্ষুদ্র বালিকা রতন অবশেষে মায়ের আসন অধিকার করেছে। ‘একরাত্রি’ আরো একটি গুরুত্বপুর্ণ গল্প। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির নতুন চেহারা আমাদের দেখিয়েছেন। কালো রাত্রি, ঘোর বৃষ্টি, সমুদ্র গর্জন, মেঘ গর্জন আর এই পরিবেশে সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে গ্রাম ভেসে যাওয়া-এ রকমই এ রকমই বর্র্ণনা আমরা ‘একরাত্রি’ গল্পে দেখতে পাই। এই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক পরিবেশেও সুরবালা তার ছোটবেলার খেলার সাথি স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের সাথে দেখা করতে গভীর রাত্রিতে পুকুর পাড়ে উঠে এসেছে। এবং এই একটি রাত্রিকে নায়ক তার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি এবং এটি তার জীবনের অক্ষয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এইভাবে দেখা যায় মানবমনের নিবিড় বিষয়গুলো তাঁর গল্পে রয়েছে । ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ একটি কিশোর চরিত্র। এই চরিত্রটি প্রকৃতির মতনই। প্রকৃতির কোলে বড় হয়েছে, প্রকৃতিকে সে যেমন ভালোবাসে তেমনই মানুষ তারাপদকেও ভালোবাসে, সবাই আপন করে নেয়, কিন্তু তারাপদ বেশিদিন কোথাও স্থির থাকে না। প্রকৃতির কিশোর আবার প্রকৃতিতেই ফিরে যায়। এমনকি নারীর বন্ধনের চেয়েও প্রকৃতির সাথে তারাপদের বন্ধন আরো মজবুত। তাই বালিকা মেয়ের মনের অভিমানকে গুরুত্ব না দিয়ে তারাপদ আবার প্রকৃতিতে বেড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির সঙ্গে তারাপদের যে সম্পর্ক তা আমাদেরকে মুগ্ধ করে। এমনইভাবে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নিশিথে’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ প্রভৃতি গল্পে প্রকৃতির প্রভাব মানবমনকে কীভাবে নিয়ন্ত্রন করেছে সে সম্পর্কটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছোটগল্পে আমাদেরকে দেখিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতিকবিতা রচনা করেছেন। আবার কাব্যসাহিত্যও রচনা করেছেন। তিনি বড় কাব্যপ্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। তিনি ছোটগল্পও রচনা করেছেন। তাই কল্পনার কিছুটা উচ্ছ্বাস তাঁর গল্পে রয়েছে। কিন্তু গীতিকবিতার যে বৈশিষ্ট্য তা তাঁর ছোটগল্পে কমই আছে। গীতিকবিতার মুল কথাই হলো লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনার কাব্যিক প্রকাশ। ব্যক্তিগত অনুভূতি সবচেয়ে বড় কথা, মূখ্য বিষয়; আর সব কিছুই লেখকের কাছে গৌণ হয়ে যায়। যেমন বিহারীলাল চক্রবর্তী দেবী সারদার ধ্যানে মগ্ন থেকেছেন। এই পৃথিবী যার হয় হোক, তাতে কবির কিছু আসে যায় না। কিন্তু দেবী সারদা তাঁর চাই। এটা একান্তই ব্যক্তিগত মনের ভাবনা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের চরিত্র, ঘটনা ও কাহিনি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এখানে রবীন্দ্রনাথ দেশ, সময়, সমাজ, পরিবেশ, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়গুলো সমান্তরালভাবে তাঁর গল্পে উপস্থাপন করেছেন। তাই তাঁর ছোটগল্পগুলো ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। যেমন সুরবালা, রহমত, রতন, তারাপদ, চন্দরা, মৃণ¥য়ী, অপূর্ব, মৃণাল-এ চরিত্রগুলো নিজস্ব পরিবেশ-পরিম-লে বিকশিত হয়েছে। চরিত্রগুলো সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা রয়েছে এবং তা চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি, লেখকের মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকে নি। বরং ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পকে প্রকৃত অর্থে গীতিধর্মী বলা যায় না।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের বিষয়বস্তুতে অভিনবত্ব রয়েছে। এখানে জমিদার আছে, রাজা-রাণীও আছে। উচ্চবিত্ত আছে, নিম্নবিত্তও আছে। প্রেম আছে, বিরহ আছে, সুখ আছে, দুঃখ আছে, কল্পনা আছে, উচ্ছ্বাস আছে। সব কিছু মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলো বৈশ্বিকমাত্রা লাভ করেছে। তাই গল্পের বিষয়বস্তু, চরিত্র, ঘটনা বিশ্লেষণ করলে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে গীতিধর্মীতার কোন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না।
সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।