চর্যাপদের রাজনৈতিক, সামাাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি আলোচনা কর।
চর্যাপদ বাংলা সাাহিত্যের প্রথম সাাহিত্যিক নিদর্শন। গুপ্তসাম্রাজ্যের শাসন পদ্ধতি থেকে পাল-সেন বর্মন রাজাদের রাজত্বকাল পার হয়ে তুর্ক আমলের অধ্যায়ে উত্তরণের সময়ের মধ্যবর্তী রাজনৈতিক, সামাাজিক এবং সাংস্কৃতিক পটভূমিতে প্রাচীন যুগের বাংলা সাাহিত্যের ঐতিহাাসিক নিদর্শন চর্যাপদ রচিত হয়েছে।
নিম্নে এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করা হল –
চর্যাপদের রাজনৈতিক পেক্ষাপট আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আসে এর রচনাকাল। চর্যাপদের রচনাকাল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। এ সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘটনাবহুল। গুপ্তরাজাদের শাসন কালের অবসান ঘটে, পাল রাজাদের শাসনের স্বর্ণযুগ চলছিল তখন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উদার বিত্তের পাল শাসকেরাই চর্যাপদ রচনার প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। চর্যাকারদের অধিকাংশই ছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী এবং চর্যাপদগুলো ছিল প্রধানত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সাধনসঙ্গীত। বুদ্ধদেবের উদার ধর্মানুসারীদের কাছে বাংলা ভাষা এবং নিম্ন বর্ণের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষেরা উপেক্ষিত ছিল না। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের নির্বিঘেœ বাংলা ভাষায় সাধনসঙ্গীত রচনায় উৎসাহ-উদ্দীপনা যুগিয়েছে। চর্যাপদে যাদের চিত্র পাওয়া যায় তারা ধর্মক্ষেত্রে বৌদ্ধ এবং অর্থনৈতিক ও সামাাজিক ক্ষেত্রে অবহেলিত-বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিিহ্নত।
চর্যাপদে সেকালের বাংলাদেশ, বাঙাালির জীবন,সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনবাস্তব রসমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। চর্যাকারগণ সাধক হলেও তারা ছিলেন সমাজের মানুষ। তাই সমাজ মানুষের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখ, হাাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অনটন এবং সর্বোপরি সমাজ মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল দিক নিপূণ শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন চর্যাপদগুলোতে। অনেক চর্যাপদে নিম্ন বর্ণের ডোম-ডোমনী, শবর-শবরী, নিষাদ, কাপাালিক ইত্যাাদির কথা আছে। আছে ব্রাক্ষণ কর্তৃক শোষণ-বঞ্চনার অমানবিক চিত্র। নিম্ন বর্ণের মানুষদের নগরের ভেতর জায়গা ছিল না, কিন্ত অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী ডোম রমণীর সঙ্গ লাভের কামনায় ব্রাক্ষণরা তাদের কুঁড়ে ঘরের আশে পাশে সময়ে-অসময়ে কামতাাড়িত হয়ে ঘুরে বেড়াতো। মানুষের দাারিদ্র্যপূর্ণ সংসার , আহার-বিহার, বিবাহ-যৌতুক নিত্য ব্যাবহার্য সামগ্রী যানবাহন, আমোদ ইত্যাাদি সব বিষয় চর্যাপদে স্থান পেয়েছে। খাবারের অভাব-অথচ অতিথি আসছে, নৌকা চালানো, হরিণ ও হাাতি শিকার এবং পোষ মানানো সে সমাজে বিদ্যমান ছিল। বিবাহ যৌতুক,নাচ-গান অলংকার, নিত্য ব্যবহার্য উপাদানের বর্ণনা চর্যাপদে যেভাবে আছে তাতে সেকালের সামাাজিক সাংস্কৃতিক জীবনের বাস্তব পটভূমি আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া রমণীরা যথারীতি সাজ-সজ্জার মাধ্যমে নিজেদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত। তারা খোঁপায় ফুল, ময়ূরের পাখা, গলায় ফুলের মালা ব্যবহার করত।
উপরের বিশ্লেষণের মূল কথা হলো- যে রাজনৈতিক সামাাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে প্রাচীন যুগের বাংলা সাাহিত্য ‘চর্যাপদ’ রচিত হয়েছিল, সে পটভূমি হল নদী-অরণ্য-পর্বত বেষ্টিত হাজার বছরের পুরোনো বাংলার বাস্তব পেক্ষাপট।