কালকেতু উপাখ্যান অবলম্বনে মুকুন্দ্ররাম চক্রবর্তীর সমাজ সচেতনার পরিচয় দাও।
মধ্যযুগের দেবদেবী নির্ভর বাংলা সাাহিত্য কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কালকেতু উপাখ্যান এক বাস্তবধর্মী ও জীবনবাদী কাব্য। গভীর জীবনবোধ, সূক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি ও ব্যাপক অভিজ্ঞতার দ্বারা কবি এতে তৎকালীন সমাজ জীবনের বাস্তব ছবি অঙ্কন করেছেন। বস্তুত, কালকেতু উপাখ্যানে বাঙাালির গার্হস্থ্যজীবন তথা গ্রামীণ সমাজের বাস্তব রূপ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রশ্নানুসারে বিষয়টি নিম্নে পর্যালোাচনা করা হলো-
নিজের আত্মপরিচয়, কালকেতু ফুল্লরা, ভাড়ুদত্ত, মুরারীশীল, ও বুলান মন্ডল চরিত্রের বিচিত্র ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে কবি বাঙাালি সমাজের নিত্য দিনের পরিচয় তুলে ধরেছেন । কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রাজা, ভূস্বামী, জমিদাারি প্রথা এবং মানুষের নিত্য দিনের কার্যক্রমের মধ্যে সমাজ বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। দেশের অরাজকতা, নিরাপত্তাহীনতা, জীবনের অনিশ্চয়তা, এবং অবক্ষয়ের কথা কবি পশুদের আর্তনাদের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। অন্তঃসত্তা নিদয়ার খাদ্য তাালিকা থেকে প্রাত্যাহিক সমাজের অভাব পীড়িত জীবনের ছবি অঙ্কিত হয়েছে। কবির বর্ণনা :
পুই ডগা মুখী কচু তাহে ফুল বড়ি কিছু
কাঁঠালের বিচি গন্ডা দশ।
কালকেতুর বিবাহ প্রসঙ্গে এসেছে তৎকালীন সমাজের ঘটকের কার্যকলাপ, প্রথা বিয়ের আড়ম্বর, বরযাত্রা, খাওয়া-দাওয়া, কন্যা বিদায়, জামাইয়ের উপহার প্রদান ইত্যাাদির চিত্র। ঘটককে পাঁচগন্ডা গুয়া ও পাঁচ সের গুড় দিতে চেয়েছে ফুল্লরার মা; আর জামাতাকে দিয়েছে তিনটে পাতন কান্ড। এছাড়া গুয়া কাটায় হৈল গন্ডগোল। এসব বর্ণনা গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত বাস্তবতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দুঃখ ছিল সেকালের মানুষের নিত্যসঙ্গী। কালকেতু ফুল্লরার সংগ্রামী জীবন তৎকালীন বাংলার দুঃখপূর্ণ জীবনের জীবন্ত ছবি। ব্যাধ রমণীরা মাংস বিক্রি করত। দরিদ্র ব্যাধের খাবার ছিল আমানি, তাও আবার খাবার পাত্র ছিল না। ধার কর্জ করার রীতি প্রচলিত ছিল। কবি লিখেছেন :
ক্ষুদ কিছু ধার নিবে সইয়ের ভবনে।
কাঁচড়া ক্ষুদের জাউ রান্ধিবে যতনে।
সমাজে উচু-নীচুর বৈষম্য ছিল। দরিদ্র নারীকে পান্তার ভরসায় থাকতে হতো এবং করতে হতো উদরের চিন্তা। তারা অন্যের ধান ভানতো, হাটে সুতা বিক্রি করতো এবং ভাঙা কুড়ে ঘরে বাস করতো। দেবী যখন নারীর বেশ ধরে ফুল্লরার গৃহে আসল, তখন ফুল্লরা তার দুঃখের কথা বলেছে এভাবে :
পাশেতে বসিয়া রামা কহে দুঃখবাণী।
ভাঙা কুড়্যা ঘরখাানি পত্রে ছাওনী।
উত্তম বসনে বেশ করয়ে বনিতো।
অভাগী ফুল্লরা করে উদরের চিন্তা।
সমাজে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। স্ত্রীরা স্বামীকে সন্দেহ করতো আবার স্বামীকে ভাগ্যবিধাতা মনে করত। ফুল্লরা ছদ্মবেশি ষোড়শী কন্যাকে স্বামীগৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য উপদেশের সুরে স্বামীর প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করছে এভাবে :
স্বামী যে পরম ধন স্বামী বিনে অন্যজন
কেহ নহে সুখ-মোক্ষ-দাতা।
সমাজে তখন কুসংস্কার আরও বেশি প্রচলিত ছিল। কালকেতু উপাখ্যানে দেখা যায় : নায়কচরিত্র কালকেতু যাত্রাপথে স্বর্ণগোাধিকা দেখে যাত্রা অশুভ মনে করে, বাম চোখ কেঁপে ওঠায় নাায়িকা ফুল্লরা বিপদের আশঙ্কা করে। তাছাড়া তারা যাদুমন্ত্রে বিশ্বাস করতো, ফুল্লরা ছদ্মবেশি দেবীচণ্ডীকে জিজ্ঞাসা করে এভাবে- ‘কে আানিল তোর ঔষুধে ছাাড়িয়া বসতি’।
সমাজে ভাল-মন্দ সব রকমের মানুষ থাকে। কিছু মানুষ সব সময় জটিল, কুটিল ও স্বার্থপর; ভাড়ুদত্ত এ রকম কুটিল প্রকৃতির মানুষ। সমাজে সামাাজিক বিচার প্রথার প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। ভাড়ুদত্তের অন্যায়ের শাাস্তিস্বরূপ মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে গলায় জুতার মালা পড়িয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়। আবার পরাাজিত ব্যক্তির শাাস্তির বিধান ছিল। তাই কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে ছোট কোটরে বন্দি করে চরম শাাস্তির ব্যবস্থা করে।
সামাাজিক ভদ্রতা ও সৌজন্যপ্রথা সমাজে চালু ছিল, তাই অন্যের বাাড়িতে দেখা করতে গেলে নানা রকমের উপহার-উপঢৌকন নিয়ে যেত। বুলানম-ল ও ভাড়–দত্ত কালকেতুর সাথে দেখা করতে গেলে ভেট নিয়ে যায়। ফুল্লরা সইয়ের বাাড়িতে সেউতি ফল নিয়ে যায়। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী আসলে দক্ষকাব্য শিল্পী, সমাজে প্রচলিত রাজনৈতিক, সামাাজিক ও সাংসাারিক খুঁটিনাাটি চিত্র অত্যন্ত দক্ষ ও শৈল্পিক উপায়ে উপস্থাপন করেছেন।
উর্পযুক্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী একজন জীবনঘনিষ্ঠ ও জীবনবাদী শিল্পী। কালকেতু উপাখ্যান গ্রন্থে তৎকালীন সমাজের সমাজ বাস্তবতার চিত্র তিনি যে শৈল্পিক বুননে উপস্থাপন করেছেন-তা অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।