বাংলা উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ শিরোনামে একটি নিবন্ধ রচনা করো।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই ঐতিহাসিক ঘটনা বাঙালির জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। দেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর ব্যাপক প্রভাব পরে। শিল্পি-সাহিত্যিকদের জীবনেও মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব বিস্তার করে। তাই সঙ্গতকারণেই বাংলা সাহিত্যেও মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব রয়েছে। সাহিত্যের যে সব শাখা রয়েছে যেমন কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস সব শাখাই কম-বেশি মুক্তিযুদ্ধ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা। এ শাখাটি মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে। নি¤েœ বাংলা ‘উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা করা হলো-
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সর্বপ্রথম উপন্যাস রচনা করেছেন আরোয়ার পাশা। তাঁর উপন্যাসের নাম হলো ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েক মাসের ঘটনা স্থান পেয়েছে। তারপর একে একে অনেক লেখক এ বিষয় নিয়ে উপন্যাস রচনা করেছেন। শওকত আলীর ‘যাত্রা’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, রেজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায়’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘নীল দংশন’, রশিদ হায়দারের ‘খাঁচায়’, হুমায়ুন আহমেদের ‘নির্বাসন’, ‘আগুনের পরশমণি’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘তালপাতার সেপাই’, রাবেয়া খাতুনের ‘মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী; দিলারা হাশেমের ‘একদা ও অনন্ত’ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উপন্যাস লিখেছেন শতকত ওসমান। ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’, ‘দুই সৈনিক’, জলাংগী’, পঞ্চসঙ্গী’, ‘নেকড়ে অরণ্য’ প্রভৃতি। শওকত ওসমান বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তিনি অসাধারণ এ সব গ্রন্থ রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা রয়েছে এ সব উপন্যাসে। পাকবাহিনি নিরস্ত্র বাঙালির উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। মানুষের জানমালের কোন নিরাপত্তা ছিল না। পাখির মতো গুলি করে পাকবাহিনি পূর্ববঙ্গের মানুষকে হত্যা করেছিল। তাই প্রিয় জন্মভূমি যেন এ দেশের মানুষের কাছে জাহান্নামের মতো মনে হচ্ছিল। তারা আপাতত দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে যায়। এই ঘটনাই লেখক ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’ উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো গাজি রহমান। গাজী রহমানের মুখে এ উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। ‘দুই সৈনিক’ আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। দুইজন পাকসৈনিক একটি বাড়িতে আমন্ত্রন খেতে আসে। খাওয়া শেষে যাওয়ার সময় এই বাড়ির যুবতী দুই মেয়েকে বাবার সামনে থেকে দুই সেনিক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। বাবা চোখে দেখেও কিছু করতে পারে নি। এ রকম আরো কত অনুষঙ্গ শওকত ওসমান এ উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। ‘জলাংগী’ উপন্যাসের নায়ক মুক্তিযোদ্ধা। তাকে নির্মমভাবে জলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। পাকবাহিনির নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য এ উপন্যাসে রয়েছে। ‘নেকড়ে অরণ্য’ উপন্যাসের কাহিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। পাকবাহিনি প্রায় ১০০ নারীকে ধরে আনে, উলঙ্গ অবস্থায় তাদেরকে একজায়গায় বন্দি করে রাখে এবং পাশবিক দৈহিক নির্যাতন চালায়। এ উপন্যাসে পাকবাহিনির উপর ঘৃণা বর্ষিত হয়েছে।
সেলিনা হোসেনের অসাধারণ একটি উপন্যাসের নাম ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’। মায়ের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান তার সন্তান। এই উপন্যাসে দেখা যায় একজন মা প্রতিবন্দি সন্তানকে পাকবাহিনির হাতে তুলে দেয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে দেয়। একজন মায়ের অতুলনীয় আত্মত্যাগ এ উপন্যাসটিকে অমরতা দিয়েছে। অত্যন্ত সহজ-সুন্দর-স্বাবলীল ভাষায় লেখক মুক্তিযুদ্ধকে বাংলা উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসটি ১৯৭৩ সালে প্রকাশ পায়। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের অসাধারণ শিল্পকর্ম। সুদীপ্ত শাহিন এ উপন্যাসের নায়ক চরিত্র। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। ঢাকা শহরেই বসবাস করতো সুদীপ্ত শাহিন। নিজের চোখে দেখেছে ঢাকা শহরের মানবিক বিপর্যয়। ঢাকা শহর এক সময়ে মানুষের কাছে স্বপ্নের শহর ছিল। কিন্তু স্বপ্নের শহর এখন দুঃস্বপ্নের শহরে পরিণত হয়েছে। উপন্যাসে অনেক চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। এর মধ্যে কবি শামসুর রাহমান, ডা. মালেক, মি. খালেক, রাজনৈতিক নেতা ফিরোজ, বিজন বিহারী, মোনায়েম খান, আইয়ুব খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ রকম উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে খুব কমই আছে।
মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ একটি অন্যতম উপন্যাস। মাহমুদুল হক নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে এ উপন্যাসে রুপদান করেছেন। খোকা এ উপন্যাসের নায়ক চরিত্র। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে খোকাকে উদাসীন দেখা যায়। নিজে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি। কিন্তু দেশবাসীর মুক্তির জন্য অপেক্ষা করেছেন। মাঝে মাঝে নানা রকম সামাজিক অসঙ্গতি দেখে নিজে নিলিপ্ত রেখেছে। সমকালীন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ খোকাকে উদাসীন করে দেয়। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরো কিছু উপন্যাস প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে তৌফিক আকন্দের ‘প্রতিমা’ অন্যতম একটি উপন্যাস। আফের সরকার, বীরেন, মেনাজ, শের আলী, মেনাজের স্ত্রী এ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। ঔপন্যাসিক বেশ দক্ষতার সাথে এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় ও সমাজকে তুলে ধরেছেন। আফের সরকার পাকবাহিনির সাথে হাত মেলায়, গ্রামের নারীকে মেজরের হাতে তুলে দেয়। নিজের ঘরে দুই স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও মেনাজের বউকে গর্ভবতী করে। সামান্য সোনার লোভে বীরেনকে হত্যা করে-এমনই একজন জঘন্য স্বভাবের মানুষ আফের সরকার। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে তৌফিক আকন্দের ‘প্রতিমা’ একটি অনন্য সংযোজন।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা, পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, লেখকগণ মুক্তিযুদ্ধকে অনেক উপন্যাস রচনা করেছেন। অত্যন্ত সহজ-সরল-সুন্দর ভাষায় তাঁরা কাহিনি ও বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলা উপন্যাস সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে।