আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য অবলম্বনে সিংহল দ্বীপের বর্ণনা দাও।
উমধ্যযুগের রোমাান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের মধ্যে ‘পদ্মাবতী’ একটি অন্যতম কাব্যগ্রন্থ। এটি একটি সার্থক ও সফল রোমাান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। এ কাব্যের মূল রচয়িতা হিন্দি ভাষার কবি মাালিক মুহম্মদ জায়সী। পরবর্তীতে বাংলায় অনুবাদ করেছেন মহাকবি আলাওল। গ্রহণ, বর্জন আর সংযোজনের মধ্য দিয়ে তিনি ‘পদ্মাবতী’ কাব্যটিকে নতুন রূপ দান করেছেন। এ কাব্যে সিংহল দ্বীপ বর্ণনা অংশে কবি সিংহল দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন। নিম্নে সিংহল দ্বীপের সংক্ষিপ্ত বর্ননা উপস্থাপন করা হলো –
সুন্দরের একটি আলাদা আকর্ষন ক্ষমতা আছে এবং তা স্বাভাাবিকভাবে আমাদেরকে আকর্ষন করে থাকে। আমরা সবসময় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। সিংহল দ্বীপের এমনই সৌন্দর্য কবি বর্ণনা করেছেন যে, তা আমাদেরকে মুগ্ধ করে। কবি রাজসভা থেকে শুরূ করে বন, উদ্যান, সরোবর, পশু, পাাখি, আচার-আচরণ, রীতিনীতি, জীবনধারন প্রণালীর সাার্বিক চিত্র তাঁর তুলির শৈল্পিক আঁচড়ে অঙ্কন করেছেন। ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে মোট নয়টি দ্বীপের উলে−খ আছে। এর মধ্যে সিংহল দ্বীপ সবচেয়ে সুন্দর। এ দ্বীপের রাজার নাম গন্ধর্বসেন, রাজকুমারী পদ্মাবতী; গোটা রাজ্য সৈন্য দ্বারা সুসজ্জিত, রাজার ঘোড়াশালে ষোল হাজার ঘোড়া এবং হাাতিশালে সাত হাজার শক্তিশালী হাাতি আছে। তার ভয়ে চাারিদিক কম্পিত, সকলেই তার কাছে মাথা নত করে।
সিংহল দ্বীপে সব সৌন্দর্যের সমাহার ঘটেছে। এটি স্বর্গের সদৃশ্য করে কবি সিংহল দ্বীপের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। চারদিক ঘন উপবনে ঘেরা। বনের গাছগুলো শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আকাশের সঙ্গে মিশে আছে। তরুসমূহ সর্বদা মৃদুমন্দ বাতাসে চন্দনের সুবাস বিলিয়ে দিচ্ছে। গাছের ছায়াগুলো অত্যন্ত সিগ্ধ পরিবেশ সব সময় শীতল থাকে। এখানে বসন্ত ছাড়া অন্য কোন ঋতু নেই। তাই গাছগুলো সব সময় ফুলে আর ফলে সুশোাভিত থাকে। সব মিলিয়ে সিংহল নন্দন কাননতুল্য। পথিকেরা এখানে সব সময় বিশ্রাম নিয়ে শরীরের ক্লাান্তি দূর করে।
সিংহল দ্বীপের বৃক্ষগুলো সবসময় ফলভারে নত হয়ে থাকে। এ ফলের শোভাময় সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে। এ সব ফল মধুর চেয়েও মিষ্টি আর ফুলের চেয়েও সুগন্ধীময়। এখানে নানা জাতের ফল সারাবছর পাওযা যায়। এ সব ফলের মধ্যে বড়হর, খেজুর, গুয়া, নারকেল, তাল, ডাালিম, কমলা, কামরাঙ্গা, জামির, মহুয়া, বাদাম, বেল, কলা, আখরোট, লবঙ্গ, জলপাই, আম, জাম ও কাঁঠাল উল্লেখযোগ্য ।
সিংহল দ্বীপে ছোটি-বড় অনেক দীঘি, পুকুর ও সরোবর আছে। এ সব দীঘির জল দুধের মতো সাদা ও কর্পুরের মতো সুগন্ধযুক্ত। দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে। আর খেলেই মন রোমাান্টিক ভানবায় ভরে যায়। সরোবরে নানারকম পদ্ম ফুটে আছে। ফুলের মধু পান করার জন্য সারাক্ষণ ভ্রমর উড়ছে, রাজহাস ঘুরে বেড়া”্ছে আর মাঝে মাঝে জলকেলি করছে। স্থানে স্থানে শাপলা ফুটে আছে যা আকাশে অসংখ্য তারার সাথে তুলনা করা চলে। হাঁস, চক্রবাক, সারস, শাালিক, শুক সারী, জলকাক, বক ইত্যাাদি প্রজাপ্রাতির পাাখি কখনও ঝাঁকে ঝাঁকে আকাশে উড়ছে আবার কখনও সরোবরে ঝাাঁপিয়ে পড়ছে। পুকুরের পাড়ে উদ্যান শোভা পাচ্ছে। উদ্যান চন্দন সুবাসে আমোাদিত। নানা ফুলে শোভাময়। মালতী, যুথী, লবঙ্গ, গোলাপ, চাঁপা, কেতকী, বাসক, কুরবক ইত্যাাদি ফুল ফুটে উদ্যানকে আকর্ষনীয় করে তুলছে। সব মিলিয়ে সিংহল দ্বীপ এক অসাধারণ নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরে উঠছে।
উপবনে নানা পাাখি নানা সুরে নানা গান গায়। পাাখির গানে হৃদয় পুলকিত হয়। এ সব পাাখির মধ্যে কোাকিল, সাারি, শুক, পাাপিয়া উল্লেখযোগ্য। দ্বীপের স্থানে স্থানে কূপ আছে। এ সব কূপের চারদিক স্বচ্ছ পাথর দ্বারা বাঁধানো। স্থানে স্থানে মন্ডপ শোভা পাচ্ছে, মন্ডপে লোক বসবাস করে। তারা নান রকম পোশাক পড়ে আছে। কেউ হরি, কেউ নাথ, আবার কেউ দিগম্বর বা মহেশের রূপ ধারণ করে আছে। নগরবাসীদের মুখে হাসি, তারা সব সময় সুখী মানুষ। সকলেই শ্বেত, রক্ত ও পীত বস্ত্র পরিধান করে। প্রতিটি গৃহেই সুন্দরী পদ্মিনী নারী আছে। তাদের রূপ দেখে দেবতার স্ত্রীরাও লজ্জা পায়।
সিংহল দ্বীপের স্থানে স্থানে হাট বসে। হাটের রাস্তাগুলো সব বাঁধানো, কোথাও কোন কাদা নেই, সে সব হাটে হীরা, মুক্তা, মাানিক্য ও গজমতি বেচাকেনা হয়। সুন্দরী নারীরা পসরা করে। তাদেরর অঙ্গে নানা অলঙকার শোভা পাচ্ছে। কানে রত্নমতি কুল, মুখে তাম্বুল। তাদের ভ্রূযুগল ধনুকের মতো বাঁকানো। তাদের দিকে চোখ পড়লেই পুরূষের মন মোাহিত হয়ে যায়।
সিংহল দ্বীপ অতি সুরক্ষিত। রক্ষীরা রাত জেগে পাহারা দেয়। কোন চোর-ডাকাত সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। সেখানে দুটি নদী আছে, সেখানে সুন্দরী নারীরা জল ভরে। এখানে একটি কূপ আছে যার জল খেলে বৃদ্ধও তরূণ হয়ে যায়। সেখানে সোনাবরণ একটি গাছ আছে, যে গাছের ফল খেলে মানুষ কখনও জরাগ্রস্থ হয় না। রাজা গন্ধর্বসেনের রাজপ্রাসাদ অতি সুচারূ, যা ইন্দ্রের সভার সাথে তুলনা করা চলে।
উপর্যুক্ত আলোচনা, পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, সিংহল দ্বীপের সৌন্দর্য অতুলনীয়। কবি সিংহল দ্বীপের যে বর্ণনা পদ্মাবতী কাব্যে দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিচয় পাওয়া যায়।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।