অলংকার কী? সাহিত্যে (কাব্য) অলংকারের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
অলংকার শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো গহনা, ভূষণ, আভরণ ইত্যাদি। সাহিত্যে এ শব্দটির অর্থ ভাষার সৌন্দর্য ও মাধুর্যবৃদ্ধিকারী গুণ। তাই সাহিত্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ভাষা প্রয়োগের একটি বিশেষ রীতির নাম অলংকার। যেমন : অনুপ্রাস, রুপক, উপমা ইত্যাদি। এই অলংকার শাস্ত্রের উৎপত্তি হয়েছে প্রাচীনকালে গ্রিক ভাষার সাহিত্য থেকে। তারপর আস্তে আস্তে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ছড়িয়ে পড়েছে। উপমহাদেশেও প্রাচীনকাল থেকেই অলংকারের প্রয়োগ রয়েছে।
অলংকার সম্পর্কে বিভিন্ন আলংকারিক যেমন দণ্ডী, বামন, বিশ্বনাথ কবিরাজসহ নানাজন নানাভাবে অলংকারের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। অলংকার সম্পর্কে তিনি বলেন-‘যে গুণ দ্বারা ভাষার শক্তি বর্ধন ও সৌন্দর্য সম্পাদন করা হয়, তাকেই অলংকার বলে।’
অলংকারের প্রয়োজনীয়তা :
সাহিত্যে অলংকারের প্রয়োজনীয়তা সবাই স্বীকার করেছেন। অলংকার শব্দটি সন্ধি দিয়ে গঠিত হয়েছে। শব্দটি এ রকম, অলম+কার=অলংকার, ‘অলম’ সংস্কৃত শব্দ, অর্থ ভূষণ। ‘কার’ সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ‘অলংকার’ শব্দের অর্থ হয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। অলংকার এমন একটি উপাদান যা ভাষার ভেতরে লুকিয়ে থেকে ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তাই প্রাচীনকালের দন্ডী, বামন, বিশ্বনাথ কবিরাজ থেকে আধুনিক কালের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সবাই এক বাক্যে অলংকারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। নারীদেহে সব সময় স্বাভাবিক সৌন্দর্য থাকে। এ সৌন্দর্য আমাদেরকে মুগ্ধ করে। কিন্তু নারী মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার করে। এতে তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যের সাথে বাড়তি সৌন্দর্য যুক্ত হয়। সাহিত্যেও অলংকারও তেমনই। ভাষার স্বাভাবিক সৌন্দর্য থাকে। এর সাথে অলংকার যুক্ত হলে কাব্যসাহিত্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। যেমন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কল্পনা’ কাব্যের ‘দুঃসময়’ কবিতায় বলেছেন-
‘ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর
এখন, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা’।
এই কবিতার চরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুৃপ্রাসের সফল প্রয়োগ দেখিয়েছেন। অনুপ্রাসের প্রয়োগে কবিতার নান্দনিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি রবীন্দ্রনাথ এভাবে বলতেন-‘হে পাখি, পাখা বন্ধ করো না’ তাহলে ভাষা এতো সুন্দর হতো না। পাঠকের হৃদয়ে স্পর্শ করতো না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ নামক প্রবন্ধে অলংকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছেন-‘হৃদয়ের ভাব উদ্রেক করিতে সাজ-সরঞ্জাম অনেক লাগে। সাহিত্যও আপন চেষ্টাকে সফল করিবার জন্য অলংকারের রুপকের, ছন্দের, আভাসের ইঙ্গিতের আশ্রয় গ্রহণ করে।
অলংকার কোন দ্রব্য নয়, এটি একটি বিশেষ উপাদান যা সাহিত্যের মাধুর্য বাড়ায়। অলংকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। ভাষাবিজ্ঞানী মহাম্মদ দানীউল হক বলেছেন, ভাষা সৃষ্টিকর্তার অসাধারণ দান। এই ভাষার মাধ্যমে আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি। ভাষার সাথে অলংকার যুক্ত হলে সাহিত্য সৃষ্টি হয়। এই অলংকার ভাষার ভেতরে-বাইরে সব জায়গায় থাকে এবং কাব্যে রস ও মাধুর্য সৃষ্টি করে। অলংকার কাব্যের শোভা বাড়ায়, কাব্যকে শিল্পমণ্ডিত করে তোলে, পাঠকের কাছে বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে। অলংকার পাঠকের হৃদয়ে একটি বিশেষ আবেদন তৈরি করে। অলংকার পাঠক ও শ্রোতা সবার কানেই শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি করে। হৃদয়েও গেঁথে যায়।
অলংকারের বিশেষ ছন্দ মাধুর্য আমাদেরকে মুগ্ধ করে। যেমন : জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার একটি চরণ ‘চুলতার কবেকার অন্ধকার বিদীশার নিশা’ আমাদের মুগ্ধ করে। এই চরণে কবি চারবার ‘র’ ধ্বনির প্রয়োগ করেছেন। এতে কবিতায় বিশেষ সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে যা সব শ্রেণির পাঠককে মুগ্ধ করে। তাই সার্বিক-বিচার-বিবেচনায় এ কথা সবাই স্বীকার করেছেন যে, সাহিত্যে অলংকারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
আমার কাছে বেশ কার্যকর উদ্যোগ বলে মনে হয়েছে
। সর্বদা এই ওয়েবসাইটের মঙ্গল কামনা করি। আমার মনে হয় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একবার হলেও এই সাইট ঘুরে দেখা উচিত।