অমিত্রাক্ষর ছন্দ কাকে বলে। অক্ষরবৃত্ত ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অনার্স ৩য় বর্ষ
অনার্স ৩য় বর্ষ

অমিত্রাক্ষর ছন্দ কাকে বলে। অক্ষরবৃত্ত ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি বাংলা কাব্যে ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দ প্রবর্তন করেন। মধুসূদন দত্ত এই ছন্দ পয়ার ছন্দের উপর ভিত্তি করে পুননির্মাণ করেন। এক সময় করিবা পয়ার ছন্দে কবিতা রচনা করতেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও পয়ার ছন্দে প্রচুর কবিতা রচনা করেছেন। পয়ার ছন্দে কবিতার একটি চরণে দুইটি পর্ব থাকে, প্রথম পর্বে আট মাত্রা এবং শেষ পর্বে ছয় মাত্রা মিলে মোট চৌদ্দ মাত্রা থাকে। একটি চরণের সাথে আরেকটি চরণের মিল থাকতো, অর্থ চরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো-সংক্ষিপ্তভাবে এই হলো পয়ার ছন্দ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত একজন সৃষ্টিশীল কবি। তিনি বড় প্রতিভা নিয়ে বাংলা কাব্যজগতে আগমন করেন। তার হাতে নতুন সৃষ্টিতে বাংলা কাব্যজগত সমৃদ্ধ হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ছন্দ। বাংলা পয়ার ছন্দ ভেঙ্গে তিনি ‘অমিত্রাক্ষর’ নামে একটি নতুন ছন্দ সৃষ্টি করলেন। এই ছন্দেও পয়ারের মতো চৌদ্দ মাত্রা আছে, প্রতিটি চরণে দুটি পর্ব আছে, প্রথম পর্বে আট মাত্রা এবং শেষ পর্বে ছয় মাত্রা মিলে মোট চৌদ্দ মাত্রা হয়। তবে এ ছন্দে এক চরণের সাথে আরেক চরণের অন্ত্যমিল নেই, অর্থের প্রবাহমানতা আছে-এটাই অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রাণ, এটা মাইকেলের নিজস্ব সৃষ্টি। কেউ কেউ বলেন যে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবি মিল্টনের ‘ব্লাঙ্ক ভার্স’ থেকে ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দ বাংলায় প্রবর্তন করেন। কিন্তু বাংলা ছন্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পয়ার ছন্দ থেকেই ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দ সৃষ্টি হয়েছে। মধুসূদন হয়তো মিল্টনের কবিতার ছন্দ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের সংজ্ঞা আমরা সহজ করে এভাবে বলতে পারি, যে ছন্দে চৌদ্দ মাত্রা থাকে, অর্থের প্রবহমানতা আছে কিন্তু এক চরণের সাথে আরেক চরণের অন্ত্যমিল নেই তাকে ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দ বলে। ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দ আসলে পয়ার ছন্দ ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আধুনিক রুপ। বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুকুমার সেনসহ প্রায় সবাই এ ছন্দের প্রশংসা করেছেন। পরবর্তীসময়ে নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্র, কায়কোবাদসহ অনেক কবি এ ছন্দে কবিতা রচনা করেছেন।

অমিত্রাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্য :
১. অমিত্রাক্ষর ছন্দে চৌদ্দ মাত্রা থাকে।
২. প্রতি চরণে দুটি পর্ব থাকে।
৩. প্রথম পর্বে আট মাত্রা থাকে।
৪. দ্বিতীয় পর্বে ছয় মাত্রা থাকে।
৫. এ ছন্দে অন্ত্যমিল নেই।
৬. এক চরণের সাথে আরেক চরণের অন্ত্যমিল নেই।
৭. এ ছন্দে অর্থের প্রবহমানতা থাকে।
৮. অর্থ কোন চরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।
৯. অর্থ অনুসারে যতি বসে।
১০. অর্থ অনুসারে ছেদ বসে।
১১. এ ছন্দে প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার হয়।
১২. এ ছন্দে সমাসবদ্ধ শব্দ বেশি ব্যবহার হয়।
১৩. এই ছন্দে অনুপ্রাসের ব্যবহার বেশি হয়।
১৪. অমিত্রাক্ষর ছন্দের ভাষা গম্ভীর হয়।
১৫. এ ছন্দ গম্ভীর অর্থ প্রকাশে সহায়ক।
১৬. এ ছন্দে ভাব একাধিক চরণে প্রবাহিত থাকে।
১৭. এ ছন্দের লয় ধীর।
১৮. এ ছন্দে ভাষা গতিশীল হয়।
১৯. বক্তব্য ব্যঞ্জনাময় হয় এবং মহাকাব্যের মতো বিশাল ভাব প্রকাশ করতে পারে।।
২০.এ ছন্দ পয়ার ছন্দেরই আধুনিক রুপ।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য :

১.অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মূল পর্ব দুটি-আট ও ছয় মাত্রার।
২. এ ছন্দে শব্দের আদি ও মধ্যের যুগ্মধ্বনি ঠাসা বা সংশ্রিষ্ট উচ্চারণে একমাত্রার এবং শেষের যুগ্মধ্বনি বিশ্লিষ্ট উচ্চারণে দুই মাত্রার।
৩.এ ছন্দে সাধুভাষার ব্যবহার বেশি।
৪.এ ছন্দে লয় ধীর বা মধ্যম।
৫.এ ছন্দে চরণস্থ পর্বসমূহে অক্ষর ধ্বনিকে আচ্ছন্ন করে একটা অতিরিক্ত সুরের তান নিয়ত প্রবাহমান।
৬.এ ছন্দ যেহেতু অক্ষর সর্বস্ব; তাই এর অক্ষর গুণে মাত্রা ঠিক করলেই চলে।
৭.এ ছন্দে আদি ও মধ্যের যুগ্মধ্বনি বা বদ্ধাক্ষর চার জায়গায় দ্বিমাত্রিক।
৮.এ ছন্দে তানের প্রবাহে এর অন্তর্গত যুক্ত ব্যঞ্জনের মাত্রা সংকুচিত হয়ে একমাত্রা হয়।
৯.এ ছন্দের ভাব ও ভাষা গভীর, গম্ভীর, বিপুল এবং বিশাল।
১০.এ ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সাধারণ শোষণশক্তি যার ফলে যুক্তাক্ষরবিহীন পর্বকে যুক্তাক্ষরবহুল করলেও এর মাত্রা সংখ্যার কোন তারতম্য হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *