অগ্নিবীণা কাব্যের শিল্পমূল্য আলোচনা কর।

অগ্নিবীণা
অগ্নিবীণা

অগ্নিবীণা কাব্যের শিল্পমূল্য আলোচনা কর। (সফলতা/সার্থকতা/কাব্যগুণ/কাব্যশৈলি/কাব্যমূল্য/ভাব ও ভাষা)

রবীন্দ্রযুগে জন্মগ্রহণ করেও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁর কাব্যপ্রতিভার গুণে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে তাঁর গুরুত্ব ও খ্যাতি সর্বজন স্বীকৃত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাতের মধ্যবর্তী সময়টুকু কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যপ্রতিভার বিকাশকাল। নজরুলের কাব্যসংখ্যা বেশ ব্যাপক ও বিস্তুত। তন্মধ্যে ‘অগ্নিবীণা’(১৯২২) তাঁর অন্যতম ও প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থে মোট বারটি কবিতা রয়েছে। ‘প্রলয়োল্লাস’ প্রথম কবিতা। অনান্য কবিতা হলো ‘বিদ্রেহী’, ‘রক্তাম্বধারিণী মা’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’, ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’, ‘রণ-ভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবাণী’ ও ‘মহররম’ইত্যাদি। বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপনাশৈলি ও কাব্যিক ব্যঞ্জনায় ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কবিতায় এক অনন্য মাত্রা সংযুক্ত করেছে। নিম্নে অগ্নিবীণা কাব্যের শিল্পমূল্য আলোচনা করা হলো-

নজরুল ইসলাম দেশপ্রেমিক কবি, মানবপ্রেমিক কবি। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যই পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটে। মানুষ ও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য তাঁর মায়াবি অন্তর কেঁদে উঠে। আর তাই বাংলায় পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করবার প্রত্যয়ে তিনি বাংলা কাব্যে নতুন হাওয়া বইয়ে দেন। প্রভাবশালী শাসকসত্তার বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহী ঘোষণা করেন। রচনা করেন ‘অগ্নিবীণা’র মতো আগুনঝরা কবিতা। তাঁর প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ সকল অত্যাচার, অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে। অত্যাচার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোন মতেই শান্ত হবেন না-এটি তাঁর দীপ্ত শপথ। নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বলছেন-

আমি বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর কড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।

কাজী নজরুল ইসলাম মন ও মেজাজে অসাম্প্রদায়িক কবি। তিনি সমগ্র মানবতার মুক্তির জন্য হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিলন কামনা করেছেন। কবি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয় জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে একসাথে সমন্বয় করে জাতীয় মুক্তির জন্য আন্দোলনের উৎসাহ যুগিয়েছেন। এ জন্য তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় পুরাণের মধ্যে সমন্বয় ও সংযোগসাধন করে বাংলা কাব্যে এক ভিন্নমাত্রার শোভা সংযুক্ত করেন। নজরুল ইসলাম জাতির সঙ্কটকালে ধূমকেতুর মতো বাংলা কাব্যাঙ্গনে এক ঐশ্বরিক মুক্তির বাণী নিয়ে বাংলাদেশে আবিভূত হোন। তিনি সব ধরণের অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের অবসান চান। ন্যায় ও কলাণের বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। দেশবাসীকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তির আনন্দ দিতে চান। তিনি ভারতবাসীর সম্পন্ন স্বাধীনতা চান। তাই তিনি পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার আহবান জানান। কবির আহবান :

কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল করলে লোপাট

নজরুল ইসলাম এক রোমান্টিক কবি কল্পনার নাম। একই কবির দুইটি পৃথক সত্তা। একদিকে শাসক আর শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; মানবাত্মার শান্তির মুক্তির দূত। আর অপরদিকে তাঁর মধ্যে রয়েছে অফুরন্ত রোমান্টিক প্রেমের উৎস। দুই যুগল সত্তার মিথস্কিয়ায় তিনি বাংলা কাব্যাঙ্গনে অতুলনীয়, অসাধারণ মানবপ্রেমিক। একই সাথে প্রেম ও বিদ্রোহের প্রবল স্রােতধারা বহমান। এটিই নজরুলের রোমান্টিক কবিমানস। এখানে একটি প্রাসঙ্গিক কবিতার চরণ উল্লেখ্য-

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তুর্য
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা, তার কাঁকন চুরির কন-কন।

বাংলা কবিতার গঠন কাঠামো, শব্দ নির্বাচন, উপস্থাপনা ও শিল্পিত বিন্যাসের ক্ষেত্রেও বিদ্রোহ করেন। তিনি অনায়াসে আরবি, ফারসি, হিন্দি ও বিদেশি শব্দের সংযোগ-নৈপুণ্যে এক অসাধারণ শিল্পীসত্তার পরিচয় দেন। তাই নজরুলের বিদ্রোহ সর্বত্র। এ বিদ্রোহ শান্তি ও স্বাধীনতাকামী আপমর জনসাধারণের পক্ষে, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই-নহে কিছু মহীয়ান’-এ কথাই নজরুলের কবিতার মূলমন্ত্র। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১২টি কবিতা আছে। হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে এ কবিতাগুলোকে মোটাদাগে দুইভাবে ভাগ করা যায়। প্রথমত হিন্দ্র পুরাণ ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতা। যেমন-প্রলয়োল্লাস, রক্তাম্বর-ধারিণী মা, আগমনী, ধূতকেতু। দ্বিতীয়ত মুসলিম পুরাণ ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতা। এ কবিতাগুলোর মধ্যে কামাল পাশা, আনোয়ার, রণ-ভেরী, শাত-ইল আরব, খেয়াপারের তরণী, কোরবানী। সবচেয়ে আলোচিত ও বহুল পঠিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমন্বয় দেখানো হয়েছে। উভয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে বিদ্রোহী কবিতাটি অসাধারণ শিল্পফসল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।‘বিদ্রোহী’ কবিতার দুটি চরণ উল্লেখ্য-

আমি বজ্র, ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্কার মহা-হুঙ্কার

হিন্দু ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতাগুলোতে যে সব কিংবদন্তি চরিত্র ও পৌরাণিক মিথ ব্যবহৃত হয়েছে, এর মধ্যে নটরাজ, জমদগ্নি, ইন্দ্রানীসুত, বিশ্বামিত্র, অফিয়াসের বাঁশরী, শ্যাম, বিষ্ণু, দেবী চণ্ডী, পরশুরাম, বলরাম, ভৃগু, ভগবান অভিমুন্য, পিনাক, রুদ্র, শিব প্রভৃতি।

মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতাগুলোতে যে সব কিংবদন্তি চরিত্র ও ঐতিহাসিক পেক্ষাপট প্রযুক্ত হয়েছে; তন্মেধ্য শাতিল আরব, দজলা, ফেরাত, কামাল পাশা, আনোয়ার, ‘জুরফেকার আর হায়দারী’ হাঁক, হযরত আলী এর বিশ্বত্রাস তরবারী, ইবরাহীম, আরশ, আসমান, আল্লাহ, কোরবান, মোহররম, কারবালা, ফোরাত, মা ফাতেমা, সকীনা, কাসিম, বানু, আসগর ও জয়নাল আবদীন প্রমুখ। এভাবে মুসলিম ঐতিহ্যের গৌরবকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি মুসলিম সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করেছেন।

অগ্নিবীণা কাব্যের শিল্পমূল্য আলোচনা কর ।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *