অগ্নিবীণা কাব্যে হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের ব্যবহারে নজরুল ইসলামের সফলতা আলোচনা কর।
রবীন্দ্রযুগে জন্মগ্রহণ করেও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁর কাব্যপ্রতিভার গুণে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে তাঁর গুরুত্ব ও খ্যাতি সর্বজন স্বীকৃত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাতের মধ্যবর্তী সময়টুকু কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যপ্রতিভার বিকাশকাল। নজরুলের কাব্যসংখ্যা বেশ ব্যাপক ও বিস্তুত। তন্মধ্যে ‘অগ্নিবীণা’(১৯২২) তাঁর অন্যতম কাব্যগ্রন্থ। প্রশ্নানুসারে নিন্মে অগ্নিবীণা কাব্যে অবলম্বনে নজরুল ইসলামের হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্য সমন্বয়ের সফলতা আলোচনা করা হলো –
কাজী নজরুল ইসলাম মন ও মেজাজে অসাম্প্রদায়িক কবি। তিনি অগ্নিবীণা কাব্যে সমগ্র মানবতার মুক্তির জন্য হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিলন কামনা করেছেন। কবি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয় জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে একসাথে সমন্বয় করে জাতীয় মুক্তির জন্য আন্দোলনের উৎসাহ যুগিয়েছেন। এ জন্য তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় পুরাণের মধ্যে সমন্বয় ও সংযোগসাধন করে বাংলা কাব্যে এক ভিন্নমাত্রার শোভা সংযুক্ত করেন। তবে সব সময় তাঁর লক্ষ্য ছিল দেশ ও জাতির মুক্তি ও কল্যাণসাধন।
অগ্নিবীণা কাব্যে মোট ১২টি কবিতা আছে। হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে এ কবিতাগুলোকে মোটাদাগে দুইভাবে ভাগ করা যায়। প্রথমত হিন্দ্র পুরাণ ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতা। যেমন-প্রলয়োল্লাস, রক্তাম্বর-ধারিণী মা, আগমনী, ধূতকেতু। দ্বিতীয়ত মুসলিম পুরাণ ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতা। এ কবিতাগুলোর মধ্যে কামাল পাশা, আনোয়ার, রণ-ভেরী, শাত-ইল আরব, খেয়াপারের তরণী, কোরবানী। আর সবচেয়ে আলোচিত ও বহুল পঠিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমন্বয় দেখানো হয়েছে। উভয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে বিদ্রোহী কবিতাটি অসাধারণ শিল্পফসল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এখানে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার দুটি চরণ উল্লেখ্য-
আমি বজ্র, ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্কার মহা-হুঙ্কার
হিন্দু ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতাগুলোতে যে সব কিংবদন্তি চরিত্র ও পৌরাণিক মিথ ব্যবহৃত হয়েছে, এর মধ্যে নটরাজ, জমদগ্নি, ইন্দ্রানীসুত, বিশ্বামিত্র, অফিয়াসের বাঁশরী, শ্যাম, বিষ্ণু, দেবী চন্ডী, পরশুরাম, বলরাম, ভৃগু, ভগবান অভিমুন্য, পিনাক, রুদ্র, শিব প্রভৃতি। কবি হিন্দু সম্প্রদায়ের অতীত ঐতিহ্য, অতীত ইতিহাস ও গৌরবের কাহিনি স্মরণ করিয়ে তাদের স্বাধীনতার মন্ত্রে জেগে ওঠার আহবান জানিয়েছেন। নটরাজ, মা দুর্গা ও দেবী চ-ীর অসীম ক্ষমতা ও সৃষ্টি গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চান। মা দুর্গার মতো শক্তি নিয়ে দেশবাসী যেন শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন-কবি এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের কবিতাগুলোতে। কালির শক্তিমত্তার কথা তুলে কবি হিন্দু বাঙালিকে এভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন-
বিশ্ব-মায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর পর-
হাঁকে ঐ “জয় প্রলয়ঙ্কর”
মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতাগুলোতে যে সব কিংবদন্তি চরিত্র ও ঐতিহাসিক পেক্ষাপট প্রযুক্ত হয়েছে; তন্মেধ্য শাতিল আরব, দজলা, ফেরাত, কামাল পাশা, আনোয়ার, ‘জুরফেকার আর হায়দারী’ হাঁক, হযরত আলী এর বিশ্বত্রাস তরবারী, ইবরাহীম, আরশ, আসমান, আল্লাহ, কোরবান, মোহররম, কারবালা, ফোরাত, মা ফাতেমা, সকীনা, কাসিম, বানু, আসগর ও জয়নাল আবদীন প্রমুখ। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কখনো ঐতিহাসিক স্থান, কখনো ঐতিহাসিক ঘটনা, আবার কখনো ইসলামী বীরদের আত্মত্যাগের কথা কবিতার মধ্য দিয়ে শিল্পরুপ দিয়েছেন। ইসলামী অতীত ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময়।‘মহররম’ কবিতায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই কারবালার প্রান্তরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, তবুও পিছপা হয় নি। ‘শাত-ইল আরব’ কবিতায় আরব বীরদের রক্তে নদীর পানি পবিত্র হওয়ার কথা বলা বলেছেন। ‘কামাল পাশা’ কবিতায় তুর্কী বীর কামালের তেজস্বীবেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কথা বলা হয়েছে। ‘খেয়া-পারের তরণী’ কবিতায় চার খলিফার ও হযরত মহাম্মদ সো: এর নেতৃত্বে বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র নির্বিঘ্নে পাড়ি দেবার কথা বলা হয়েছে। এভাবে দেখা যায় মুসলিম ঐতিহ্যের গৌরবকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি মুসলিম সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করেছেন। এখানে মুসলিম ঐতিহ্য সম্পর্কিত কবিতার দুটি চরণ উল্লেখ্য-
কাণ্ডরী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা
দাঁড়ী মুখে সারি গান-লা শারীক আল্লাহ
অগ্নিবীণা কাব্যেএভাবে দেখা যায় যে, কবি কোন একক সম্প্রদায়ের প্রতি কোন পক্ষপাতিত্ব করেন নি। বরং উভয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে পাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করবার আহবান জানিয়েছেন। তাই শৃঙ্খল মুক্তির স্পৃহা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যকে শৈল্পিক সমৃদ্ধি সংযুক্ত করেছে।
উপর্যুক্ত আলোচনা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, নজরুল ইসলাম একজন অসাম্প্রদায়িক কবি। বাংলা কাব্যে তিনি উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্য সংযোগসাধনে বাংলা কাব্যসাহিত্যে তিনি এক অসাধারণ শৈল্পিক সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।
এই প্রশ্নটি আরো যে ভাবে পরীক্ষায় আসতে পারে-অগ্নিবীণা কাব্যে (হিন্দু ঐতিহ্য/মুসলিম ঐতিহ্য/উভয় ঐতিহ্যের সমন্বয়/পুরাণের সফল প্রয়োগ)