ভিক্টোর হুগোর ‘লা মিজেরাবল’ : প্রসঙ্গ চরিত্র-চিত্রণ
এম আবদুল আলীম
বিশ্ব-সাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিনশ্বর প্রতিভার নাম ভিক্টোর হুগো। তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, কবি এবং মানবদরদী ঔপন্যাসিক। তাঁর ‘লা মিজারেবল্’ উপন্যাসটি ‘সর্বজনবন্দিত, রসোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ এবং মানবজাতির চিরন্তন সম্পদ। ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্ল¬বের পটভূমিতে রচিত এ উপন্যাস সমকালীন ফরাসি সমাজজীবনের এক জীবন্ত দালিল। এ-উপন্যাসে চরিত্র রূপায়ণে লেখক অভিনব কৌশল ও অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির গুণে উপন্যাসের চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অতি মানবতার উন্মেষ ঘটিয়ে সামান্য সূচনা থেকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিবর্তনের মাধ্যমে তিনি তাদের মাঝে মহাত্ম্য আরোপ করেছেন। উপন্যাসটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলে দেখা যায়, চরিত্র দিয়ে কাহিনির সূত্রপাত অর্থাৎ চরিত্রের ওপর ভর করেই উপন্যাসের কাহিনি অগ্রসর হয়েছে। কয়েকটি চরিত্র প্রস্ফুটিত করে একটি নিটোল কাহিনি গড়ে তুলেছেন। পাঁচটি পর্বের দীর্ঘ কলেবরের উপন্যাস ‘লা মিজেরাবল্’। চারটি পর্বের নামকরণ হয়েছে চরিত্রের নামানুসারে। প্রথম পর্ব ‘ফান্তিন’, দ্বিতীয় পর্ব ‘কোজেৎ’, তৃতীয় পর্ব ‘মারিয়ুস’, চতুর্থ পর্ব ‘সাঁ-দিনিস’, পঞ্চম ‘জাঁ ভালজাঁ’ ; উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো হলো জাঁ ভালজাঁ, মারিয়ুস, কোজেৎ ও ফান্তিন। অপ্রধান চরিত্রের মধ্যে গোয়েন্দা জাভেরার, ডানপিঠে বালক গাভ্রোশ, খল চরিত্র তেনারদিয়ে, খাঁটি বুর্জোয়া জিয়ের্নমা, তেনারদিয়ে গিন্নি, মসিয়ে বিয়েঁভেনু ও এপোনিন উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জঁ ভালজাঁ চরিত্রটি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলোর মাঝে তাকে অবলীলায় স্থান দেওয়া যায়। তীব্র অর্থনৈতিক কষ্টে তার বেড়ে ওঠা। এক দরিদ্র পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাল্যকালেই বাবা-মাকে হারান। তিনি প্রতিপালিত হন এক বোনের কাছে। ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন, ‘প্রেম ভালোবাসা তার জীবনে ছিল বলে কেউ জানে না।’ ক্ষুধার জ্বালায় রুটি চুরি করার অপরাধে দীর্ঘ উনিশ বছর জেল খাটেন। এর ফলে সমাজ, সভ্যতা আর মানবচরিত্রের স্বরূপ সম্পর্কে একটা ভয়াল রূপ তার সামনে ভেসে ওঠে। লেখক, বলেছেন, ‘ঘৃণাই ওর সকাল থেকে সন্ধ্যার উপজীব্য, আইন, শাসন, সমাজ, ভগবান সবকিছুর ওপরে চরম অসূয়া’। নিজের প্রচেষ্টায় ভাগ্যোন্নয়ন ঘটালেও তার কপালে ‘নিন্দা’ আর ‘অপমান’ ছাড়া কিছুই জোটেনি। দুঃখী মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ ছিল – জীবন বাজি রেখে মারিয়ুস, ঘোড়ার গাড়িচালক এবং মৃত্যুপথযাত্রী নাবিকের জীবন রক্ষা করেছেন। দুঃখী ফান্তিনকে মানবিক কারণেই সেবা করেছেন। পিতৃস্নেহের অকৃত্রিমতায় লালন-পালন করেছেন কোজেৎকে, তাকে বিয়ে দিয়েছেন উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে। ভিক্টোর হুগোর ভাষায়, ‘একজন মানুষ যতটুকু ভাল হতে পারে তার সবটুকুই জাঁ ভালজাঁর আচরণে বরাবরই আছে এবং ছিল। অনেক দুঃখ ভোগ করে শেষ জীবনে সুখ পেয়েছিলেন ; কিন্তু তখনই মৃত্যু ছোবল মারে তাকে। নিয়তির নির্মম পরিহাস এটাই, যখন দুঃখ তখন বাঁচবে, আর সুখ পেলে মৃত্যুবরণ করবে। জাঁ ভালজাঁ চরিত্রের স্নেহানুভবতা তারা কীভাবে অতিমানব হয়ে উঠতে পারে জাঁ ভালজাঁ চরিত্রের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক তা দেখিয়েছেন।
নামের মধ্যেই বিপ্ল¬বের আবহ নিয়ে যে-চরিত্রটি ‘লা মিজারেবল্’ উপন্যাসে স্থান পেয়েছে, সেটি হলো ফান্তিন। এক অজ্ঞাতপরিচয় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে, সমাজের অন্ধকারে তার জন্ম। পেটের তাগিদে তাকে নামতে হয় জীবন-সংগ্রাম। সে পাড়ি জমায় শহরে। দৈহিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে একটি যুবক তার প্রেমে পড়ে। ছেলেটি এক পর্যায়ে তাকে পরিত্যাগ করে। ফান্তিনের গর্ভে ধারণ করে এক কন্যা সন্তান। সন্তানটিকে যথাযথভাবে লালন-পালনের জন্য সে তেনারদিয়ে দম্পতির কাছে অর্পণ করে। মেয়ের ভরণ-পোষণের টাকা যোগাড় করতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। মাতৃস্নেহের যূপকাষ্ঠে সে জীবন-যৌবন সবই ‘বলী দিয়েছে। সারাজীবন অসহনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগের পর জাঁ ভালজাঁর সান্নিধ্য তাকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল ; কিন্তু ততদিনে তার আয়ু শেষ হয়ে গেছে। মৃত্যুর পর জাঁ ভালজাঁ ‘ফান্তিনের পাংশু ঠোঁটের ওপর একটু হাসির আভাস দেখতে পেয়েছিল’। এর চেয়ে মর্মানি—ক জীবন উপলব্ধি আর কি থাকতে পারে? জীবিত অবস্থায় যে কোনোদিন হাসতে পারেনি, মৃত্যুর শীতল আবহ তাকে হাসার অবকাশ দিয়েছে। বেদনার বিষাদময়রূপ ফান্তিন চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে।
শ্বাশ্বত-কালের অবহেলিত মানুষের প্রতিনিধি ‘লা মিজেরাবল্’ উপন্যাসের কোজেৎ চরিত্র। সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বিকাশের জন্য মা ফান্তিন তাকে তেনরদিয়ে গিন্নির হাতে তুলে দিয়েছেল। কিন্তু কোজেৎ-এর ভাগ্যে জুটল কেবল লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। চাকরানীর কাজ, অর্ধাহার, অনাহার, পান থেকে চুন খসলেই বেদম প্রহার-এ নিয়ে শুরু হয় তার জীবন চলা। এক পর্যায়ে জাঁ ভালজাঁর সান্নিধ্যে সে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়। আদর-যতেœ বেড়ে ওঠে। দেখতে থাকে জীবনের রঙিন স্বপ্ন। মারিয়ুস তাকে জীবনসঙ্গিনী করে। জীবনে আসে নিরবচ্ছিন্ন সুখ। মারিয়ুস চরিত্রটি এ-উপন্যাসের একটা বড় অংশে জুড়ে আছে। পমেয়ারসি ও মাদমোয়াজেল জিয়ের্নমার একমাত্র সন্তান সে। শিশুকালে মাতৃহারা মারিয়ুস মাতামহের কাছে চলে আসে। পিতার সান্নিধ্য থেকে মাতামহ তাকে দূরে রাখে। বিপ্লবী পিতাকে মারিয়ুস মৃত্যুর সময় দেখলেও তাকে ভালোবাসতে পারেনি। কারণ পিতার যথাযথ পরিচয় তখনও তার জানা ছিল না। মসিয়ে মাবুফের কাছে পিতার সত্যিকার পরিচয় জানতে পেরে কবরের পাশে গিয়ে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আইন বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়ে বিপ্লবী পিতার পরিচয় তার কাছে আরও স্পষ্ট হয়। তখন তার হৃদয়ে উপচে পড়ে ‘পিতৃভক্তি আর দেশপ্রেম’। পিতার সম্মানেই ফরাসি বিপ্ল¬বের নায়ক নেপোলিয়ন হলো তার চোখে ‘জনতা প্রতিভূ মানবনেতা’। তার মুখে ফুটে উঠল সম্রাটের জয়ধ্বনি। সে হয়ে উঠল ‘পুরো গণতন্ত্রী আর প্রজাতন্ত্রের সমর্থক’। নিজের নামের সাথে যুক্ত করলেন ‘ক্যারন’ খেতাব। কলেজে পড়ার সময় এবিসির সুহৃদ সংঘের সঙ্গে তার পরিচয় হলো। লুক্সেমবার্গে ঘুরতে গিয়ে কোজেৎ-এর সঙ্গে তার পরিচয় হলো, হলো মনের মিলন। এদিকে প্যারীর আকাশে-বাতাসে বিপ্ল¬বের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিপ্ল¬বী মারিয়ুস সৈন্যদের গুলিতে আহত হয়। জাঁ ভালজাঁ প্যারীর সুড়ঙ্গ দিয়ে তাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। সে সুস্থ হয়ে ওঠে, হয় কোজেৎ-এর সঙ্গে পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ।
গোয়েন্দা চরিত্র জাভেয়ার ভিক্টোর হুগোর এক অনবদ্য সৃষ্টি। গোয়েন্দা পুলিশের জীবন্ত প্রতীক জাভেয়ার, ভয়ঙ্কর চেহারার মানুষ। কর্তব্য পালন করতে গিয়ে সে নানা কূটকৌশল অবলম্বন করে। ঔপন্যাসিকের বর্ণনায় ‘কর্তব্য তার কাছে ধর্মের মতো’। সারাজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ভগবানের আইনের কথা তার শেষজীবনে স্মরণ হয়েছে। সে অন্তর্দ্বন্দ্বে হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত। শেষপর্যন্ত ‘অস্তিত্বের বিপুল বোঝাটাই ওর কাছে হয়েছে কষ্টকর’। পুলিশের কাজের উন্নতির জন্য কয়েকটি প্রস্তাব থানায় জমা দিয়ে সে শেষ পর্যন্ত খরস্রোতা সীন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। খাঁটি বুর্জোয়া, খিটমিটে স্বভাবের মানুষ ‘লা মিজেরাবল’ উপন্যাসের জিয়ের্নমা চরিত্র। বুরবঁ বংশ তার পরম পূজ্য। ফরাসি বিপ্ল¬ব তার কাছে ছোটলোকের কাণ্ড। তার জামাতা নেপোলিয়নের সেনাবহিনীতে চাকরি করতো বলে সে তাকে বলতো ‘পরিবারের কলঙ্ক’। নাতি মারিয়ুসের ‘ক্যারন’ খেতাবকে সে চটিজুতোর সাথে তুলনা করেছে। মারিয়ুসকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে এক ধরনের কোমল স্বভাবও বিরাজমান ছিল। মানব-স্বভাবের বৈশিষ্ট্যই তো তাই, কোমলে-কঠোরেই তো মানব-চরিত্রের সার্থকতা। জিয়ের্নমা চরিত্রের স্বভাব সম্পর্কে হুগোর ভাষ্য : ‘কখনো স্নেহ, কখনো রাগ, কখনো প্রচণ্ড প্রতিশোধের ইচ্ছা, তারপরেই পিতৃসুলভ কাতরতা’।
ডানপিঠে বালক গাভ্রোশ এ উপন্যাসের আরেক জীবন্ত চরিত্র। ছোটবেলায় বাবা-মা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে তাকে নামতে হয় জীবন-সংগ্রামে ; কিন্তু তার চরিত্রে ক্লান্তির ছাপ পড়েনি। সে ‘যেমন স্ফূর্তিবাজ, তেমনি চটপটে, যেমন পাংশু রোগাটে, তেমনি চোখ-কান খাড়া বদমাশ ছোঁড়া’। পিস্তল হাতে সে বিপ্লবীদের সাথে যুদ্ধে নেমেছিল। যুদ্ধের ময়দানে সে দূরন্ত বেগে ছুটে চলতো। অবশেষে সৈন্যদের গুলিতে গান গাইতে গাইতে মৃত্যুকে বরণ করেছে। খলচরিত্র তেনারদিয়েও বেশ উজ্জ্বল চরিত্র। ওয়াটরলু যুদ্ধে সার্জেন্টের দায়িত্ব পালন করেছে। পরবর্তী কালে সরাইখানা দিয়ে সুকৌশলে অর্থ উপার্জন করেছে। সে গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতো। টাকার লোভে হেন নিচ কাজ নেই যা সে করতে পারে না। জাঁ ভালজাঁ নামে মিথ্যা কলঙ্ক রটিয়ে সে অর্থ লুফে নিয়েছে। তেনারদিয়ে গিন্নিও তার মতো নিচু স্বভাবের মানুষ। দিনিয়ে শহরের বিশপ ও মহৎ ধর্মযাজক মসিয়ে বিয়েঁভেনু, ‘প্রার্থনা’, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, দান-ধ্যান, সামান্য জমিটাতে একটু ফুল-ফলের চাষ, গরিব-দুঃখীদের সান্ত্বনা দেওয়া, আর পড়াশুনা-এ নিয়েই তার সারাদিনের প্রতিটি পল-অনুপল পূর্ণ।’ তার চরিত্রের মাহাত্ম্যে জাঁ ভালজাঁ সৎ জীবনের সন্ধান পেয়েছে। এছাড়া জাকুয়া লাবার, এপোনিন, কর্নেল পমেয়ারসি, মঁসিয়ে মাবুফ ও বিপ¬বীদের দরিদ্র ভিক্টোর হুগো অত্যন্ত দরদ মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
চরিত্র-চিত্রণ উপন্যাসের শিল্পসার্থকতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড। জীবন্ত ও প্রাণবন্ত চরিত্র-সৃষ্টির ওপর উপন্যাসের সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে। চরিত্র ও ঘটনার বহুমুখী দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি গতিময় হয়ে ওঠে। ‘লা মিজেরাবল্’ উপন্যাসে চরিত্র-চিত্রণে ভিক্টোর হুগো বিশেষভাবে সার্থক হয়েছেন। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সুস্পষ্ট জীবনাভিজ্ঞতা, অসাধারণ শিল্পপ্রতিভার গুণে চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনাচার-অবিচারে পর্যুদস্ত মানব-সন্তানের প্রতিচ্ছবি হিসেবে চরিত্রগুলো চিরকাল জাগরুক থাকবে সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয়ে।
সুত্র: প্রতিভা, বর্ষ ॥ পাঁচ, সংখ্যা ॥ প্রথম ॥ জানুয়ারি ২০১৪ খিস্টাব্দ
লেখক : অধ্যাপক,(বাংলা বিভাগ) পাবিপ্রবি