বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয় সম্পর্কে লেখ। 211001

বখতিয়ার খলজি
বখতিয়ার খলজি

বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয় সম্পর্কে আলোচনা করো।

উপস্থাপনা : বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষঠাতা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি। তিনি সাংগঠনিক প্রতিভার দ্বারা ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার হিন্দু রাজা লক্ষণসেনকে পরাজিত করে বাংলায় সর্বপ্রথম ইসলামের বিজয় পতাকা উড়িয়ে সার্বভৌম মুসলিম রাজত্বে এক নবযুগের দ্বার উন্মোচন করেন ।

বখতিয়ারের প্রাথমিক জীবন : বঙ্গবিজেতা বখতিয়ার খলজি ছিলেন জাতিতে তুর্কি এবং বৃত্তিতে ভাগ্যান্বেষী সৈনিক । দারিদ্রের পীড়নে তিনি স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং সৈনিক জীবনকে ব্রত হিসাবে গ্রহণ করার অভিপ্রায়ে বদাউনে যান এবং সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবর উদ্দীন বখতিয়ারকে নগদ বেতনে চাকরিতে নিয়োগ করেন । বখতিয়ারের ন্যায় উচচাভিলাষী ব্যক্তি সামান্য বেতনভোগী সৈনিকের পদে তৃপ্ত থাকতে পারে নি। অল্পকাল পরে তিনি বদাউন ত্যাগ করে অযোধ্যায় যান এবং সেখানকার শাসনকর্তা হুসাম উদ্দীন তাঁকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার পূর্ব-দক্ষিণ কোনে ভাগবত ও ভিউলী নামক দুটি পরগনার জায়গীর প্রদান করেন । এখানে বখতিয়ার তার ভবিষ্যৎ উন্নতির উৎস খুঁজে পান এবং ভাগবত ও ভিউলী তাঁর শক্তিকেন্দ্র হয়ে উঠে ।

বিহার জয় : ভাগবত ও ভিউলীতে অবস্থানকালে বখতিয়ার খলজি অল্প সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্য আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে থাকেন । ধনসম্পদ ও বিরাট সৈন্যবাহিনি গঠন করে রাজ্য বিস্তার করাই ছিল তাঁর পরিকল্পনা । পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে একদিন তিনি এক প্রাচীর বেষ্টিত দুর্গের মত স্থানে আসেন এবং আক্রমণ করেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ কোন বাঁধাই দিল না। এটি ছিল একটি বৌদ্ধবিহার। মুসলমানেরা ঐ স্থানের নাম দিলেন বিহার । আজ পর্যন্ত শহরটি বিহার বা বিহার শরীফ নামেই পরিচিত ।

বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয় : বখতিয়ার খলজি ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে বিহার জয় করে অনেক ধনরত্নসহ দিল্লীর শাসনকর্তা কুতুবউদ্দীন আইবেকের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং কুতুবউদ্দীন কর্তৃক সম্মানিত হয়ে বিহারে ফিরে আসেন । পরে তিনি আরও সৈন্য সংগ্রহ করে পরের বছর ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে মিনহাজ কর্র্তক বর্ণিত বাংলার রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করেন । কিন্তু সেনযুগের তাম্রশাসন সমূহ হতে একথা স্পষ্ট যে, তাদের রাজধানী ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে । রাজা যে স্থানে অবস্থান করেন সে স্থানে সাময়িক রাজধানী হতে পারে । নদীয়া ছিল গঙ্গাতীরে পবিত্র তীর্থ স্থান । এমনও হতে পারে যে, বৃদ্ধ বয়সে রাজা লক্ষণসেন সপারিষদ পবিত্র তীর্থস্থান নদীয়ায় অবস্থান করছিেেলন । ফলে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক নদীয়া আক্রমণ ইতিহাসে উলেলখযোগ্য ঘটনা ।

আক্রমণ প্রাক্কালে বাংলার অবস্থা : কুতুবউদ্দীন আইবেক কর্তৃক পুরস্কৃত হয়ে বখতিয়ার খলজী সৈন্যবাহিনি গঠন করে বাংলা জয়ের পরিকল্পনা করেন । বাংলার ধন বাংলায় হিন্দুদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ জাতিভেদ প্রথা ও সামাজিক বিশৃঙখলা তাদের ঐক্যের পথে একটি বিরাট অন্তরায় ছিল যা বখতিয়ারকে বঙ্গবিজয়ে উদ্বুদ্ধ করে । রাজা দেশ রক্ষার সুব্যবস্থা করেন । তিনি বাংলার সীমান্তবর্তী দুর্গ রাজমহলের কাছে তেলিয়ারগর গিরিপথে সৈন্য মোতায়েন করে দেশ রক্ষার ব্যবস্থা করেন । এছাড়া তেলিয়াগরের দক্ষিণদিকে বাংলার পশ্চিম সীমান্তব্যাপী অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ । মিনহাজ এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকেই ঝাড়খ- নামে অভিহিত করেছেন। তেলিয়াগড় ছাড়া অন্য কোন পথে বাংলায় প্রবেশ সম্ভব ছিল না। তাই লক্ষণসেন তেলিয়াগড় গিরিপথ সংরক্ষণ করেছিলেন।

বখতিয়ার কর্তক বাংলা আক্রমনের ঘটনা : কৌশলী সমরবিদ বখতিয়ার বাংলার প্রবেশদ্বার সম্পর্কে অবহিত হয়ে আক্রমনের সমস্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। তিনি দুর্গম ঝাড়খ- অরণ্যঅঞ্চলের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে, তার সঙ্গে মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী আসতে পেরেছিল। ফলে সকলেই মনে করে যে, তারা ঘোড়া ব্যবসায়ী এবং রাজা লক্ষণসেনের দরবারে ঘোড়া বিক্রি করতে আসছেন। বখতিয়ার খলজি ১৮ জন সেনাসহ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে রাজা লক্ষণসেনের প্রাসাদদ্বারে উপনিত হন এবং প্রাসাদরক্ষীদের হত্যা করেন। ইতোমধ্যে শহরের অভ্যন্তরে সোরগোল পড়ে যায়। এ পরিস্থতিতে রাজা লক্ষণসেন নিশ্চিত ধরে নেন যে, তেলিয়াগড় শত্রুদের অধিকারে চলে গেছে। এবং তার সেনাবাহিনি পরাজিত হয়েছে। তাই মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত রাজা নগ্নপদে পিছন দরজা দিয়ে নৌপথে পালিয়ে যান এবং বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। লক্ষণসেনের পলায়নে প্রায় বিনা যুদ্ধে নদীয়া মুসলমানদের হস্তগত হয়। ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ বাহিনি বখতিয়ার খলজির সাথে মিলিত হয়।

মিনহাজের বর্ণনায় দেখা যায় যে, বখতিয়ার তিনদিনব্যাপী নদীয়া লুট করেন এবং বিপুল ধনসম্পদ হস্তগত করেন।। অতপর বখতিয়ার নদীয়া ত্যাগ করেন এবং লক্ষ্মাবতী অধিকার করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। লক্ষ্মাবতী মুসলমান আমলে লখনৌত নামে পরিচিত। লখনৌত জয়ের পর বখতিয়ার খলজি পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বরেন্দ্র এলাকায় নিজ অধিকার বিস্তার করেন। এভাবে তিনি বাংলা জয় করে সর্বপ্রথম বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তাই ইতিহাসে বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *