প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় : হাসির গল্প গল্পের হাসি

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় : হাসির গল্প গল্পের হাসি

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ

ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধতর একটি শাখা, যেখানে লেখক অতি অল্প পরিসরে সামাজিক নানা অনুষঙ্গ ইশারা ইঙ্গিতে অতি অল্প পরিসরে অতি অল্প কথায় প্রকাশ করেন। বলা হয়ে থাকে যে-এ ছোট গল্পের যাত্রা ইউরোপীয় সভ্যতার ছোঁয়ায় নানা লেখকের নানা মনের স্পর্শে এক অসাধারণ সঞ্জীবনী শক্তি পেয়েছে। সাহিত্যের মূল উপাদান মানুষ । আর এ মানুষের বসবাস পৃথিবী নামক গ্রহের সর্বত্রব্যাপী।তাই সাহিত্য কোন ভৌগোলিক সীমা-পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। নানা দেশের নানা সাহিত্যের উপাদান ও উপকরণ, আলো ও বাতাসের মতই পর্যায়ক্রমিক প্রভাব বিস্তার করে চলে চর্তুদিকে। আর এ ভাবেই ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব বাংলা সাহিত্যে অনিবার্যভাবেই এসেছে। ছোটগল্প যার হাতে যে ভাবেই শুরু হোক এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে কবি রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে বাংলা ছোটগল্প পেয়েছে চূড়ান্ত সফলতা।রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও তাঁর পূর্বে ও পরে আজ পর্যন্ত বাংলা ছোটগল্পে এমন সফলতা আর কেউ বয়ে আনতে পারেনি- এ অভিমত সর্বজনের।
রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যগগণে সূর্যের মত উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র। যার আলোয় কম-বেশি আলোকিত ও প্রভাবিত হয়েছে বাংলা ভাষাভাষীর প্রায় সব লেখকই।তবুও যে সব লেখক রবীন্দ্র প্রভাবিত হয়েও নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে নিজস্ব পথ সৃষ্টির প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছেন এবং আপন মেধা ও মননের গুণে , নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র ধারা নবধারায় প্রবাহিত করবার শুভ সূচনা করেছেন- তাঁদের মধ্যে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২)অন্যতম। কবি হিসেবে সাহিত্যঅঙ্গনে যাত্রা শুরু করলেও  পরে ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় নিজেকে মনোনিবেশ করেছেন। প্রভাতকুমারের গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ১২টি, এতে মোট ১১৮টি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে।‘নবকথা’ গল্পগ্রন্থের মাধ্যমে পাঠক সমাজের নিকট তিনি একজন ভিন্ন মেজাজ ও স্বতন্ত্রধারার গল্পকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
রবিঠাকুরের ভাষায়-মানব জীবনের অজস্র ঘটে যাওয়া  ঘটনাবলির কোন এক ক্ষুদ্রাংশ  ছোট গল্পে বিশেষ আকার ধারণ করে শৈল্পিক মহিমায় দীপ্যমান হয়ে ওঠে।এ সমস্ত মানব সমাজের মানব জীবনের কাহিনির বৈচিত্র্যে যেমন ভরপুর তেমনই ভিন্ন মানুষের  জীবনদৃষ্টির ভিন্নতা এ জীবন কাহিনির নানারূপ বৈচিত্র্যে ভরা বিচিত্রময় অবয়ব দেখতে পাওয়া যায়। লেখকের উপস্থাপনারীতি ও স্বাতš্য¿িক পদ্ধতিতে  বিষয়বস্তুগুলোও  এক বিশেষ শৈল্পিক মহিমায় পরিদৃশ্যমান হয়ে ওঠে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের জীবন দর্শন ও সামাজিক জীবন পদ্ধতির  রূপায়ন একটি বিশেষ মাত্রায় উন্নীত। সামাজিক নানা রীতি নীতির অনুশাসন, পারিপার্শ্বিক ও সাংস্কৃতিক বিধি-বিধানের কড়া নিয়ন্ত্রণের ফাঁকে ফাঁকে জীবন যৌবনের শাশ্বত ছটফটানি মাঝে মাঝে শরৎ আকাশের  একখণ্ড মেঘমালার  মত আবির্ভাব হয়েছে। এ মেঘমালা এক মৃদু বাতাসে হয়তো উড়ে গিয়েছে। কিন্তু রেখে গিয়েছে বেদনার স্মৃতি। এ স্মৃতির সমান্তরালে রয়েছে  কিছু কিছু  অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত কিছু কিছু মুহূর্ত ও ঘটনা, এ সমস্ত অপ্রত্যাশিত ঘটনা পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা, পরিগঠন ও উপস্থাপনায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সিদ্ধহস্ত। এ সমস্ত ঘটনার  সন্নিবেশন ও উপস্থাপনার  রীতি ও পদ্ধতি  লেখকের অভিনব চিন্তনক্ষমতা ও পরিবীক্ষণের সমন্বয়ে  একটি অসাধারণ স্ফূতি লাভ করেছে। সমাজ ও সমাজস্থ মানুষের  নানা অসঙ্গতির চালচিত্র অনুধাবনের ক্ষেত্র প্রসারিত ও প্রযুক্ত করতে লেখকের নিরন্তর প্রয়াস চলমান। প্রভাতকুমারের গল্পে হাসির উপাদান থাকলেও  তিনি হাসির গল্পকার নন। স্নিগ্ধ ও লাস্যময় হাসির মোড়কে গল্পের কাহিনি  মোড়ানো হলেও তাঁর অন্তরালে রয়েছে সুক্ষè জীবন দৃষ্টির গভীর পর্যবেক্ষণশীলতা। এখানে আলোচনা কিছু নির্বাচিত গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
১.‘প্রণয় পরিণাম’ গল্পটি বাল্যপ্রেমের এক রসালো মধুর কাহিনি। নায়ক মণিলাল ও নায়িকা কুসুমলতাকে ঘিরে যে রসময় কাহিনি তা পাঠককে হাসির উপাদান যুগিয়েছে। মানিকলাল কিশোর ছেলে। কুসুম প্রতিবেশী, বাল্যকালের খেলার সাথী। বালকসুলভ আচরণের সব সীমা মানিকলালের মধ্যে বিদ্যমান। একদিন হঠাৎ পেয়ারা গাছে উঠে মানিক সদ্যস্নানরতা কুসুমকে দেখে প্রেমে পড়ে যায়। শুরু হয় প্রেম বিষয়ক কবিতা চর্চা, আর প্রভাস নামক বন্ধুটি মানিকের সহায়তায় দূতিয়ালি করতে সম্মত হয় এবং তার পিতা নন্দলাল চৌধুরীর কাছে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে। নন্দলাল পেশায় ডাক্তার, রাশভারী লোক,সবকিছু আদ্যপান্ত  মনোযোগ সহকারে শ্রবণান্তে মানিককে ডাকলেন তারপর নন্দলালের বজ্রউক্তি- ‘লবে’পড়েছিস নাকি শুনলাম ? স্টুপিড শুয়োর আজ বাদে কাল একজামিন, লেখা গেল, পড়া গেল, লব হচ্ছে ? মানিকলালের কৈশোরের প্লেটোনিক প্রেমের কিশোর সুলভ আচরণের মধ্যে দিয়ে লেখক মধুর হাস্যরস উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।
২. ‘বলবান জামাতা’ গল্পটির বিষয়বস্তু অতি সাধারণ কিন্তু উপস্থাপনা শৈলী ঘটনাসংস্থান , পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অসাধারণ। নলিনীকান্তের বিয়ের সময়ের শারীরিক গঠনপ্রকৃতি ছেলে হলেও অনেকটা মেয়েলী মোড়কে আবৃত, নাদুসনুদুস গোলগাল প্রকৃতির অবকাঠামো-এ নিয়ে বিদূষী শ্যালিকার ব্যঙ্গ বিদ্রূপে নতুন জামাতা নলিনীকান্ত মানসিকভাবে ভীষণ অপমানিতবোধ করে।ফলে প্রতিবার মৌখিকভাবে না দিয়ে বাস্তবিক প্রামাণ্যিকভাবে  জবাব দেবার মানসে নলিনীকান্ত নিয়মিত ব্যায়াম শুরু করে। চলে একটানা দু’বছর, ফলাফল হাতে হাতে, নলিনীকান্তের মেয়েলী গঠনের পরিবর্তে পৌরুষালী চেহারায় তাকে বীর বাহাদুর বলে প্রতিভাত হয়। তারপর শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করে। মহেন্দ্র উকিল হল তার নামজাদা শ্বশুর; কিন্তু বিপত্তি ঘটল এ নামে একই এলাকায় দুজন উকিল থাকায় । পাঞ্জাবি, লম্বা পায়জামা , মাথায় পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় নলিনী হাতে একটি লাঠি এবং মালপত্রের সঙ্গে একটি বন্দুকের বাক্র,সবকিছু মিলিয়ে যেন যুদ্ধযাত্রা, কিন্তু নলিনী পৌঁছে যায় ভুল ঠিকানায়।বাড়ির কর্তা উপস্থিত না থাকায় চাকর,দাড়োয়ান সহ বাড়ির সবাই যথাসাধ্য জামাতাকে আপ্যায়ন কর। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই নলিনী বুঝতে পারল যে সে ভুল ঠিকানায় এসেছে। ইতোমধ্যে বাড়ির লোকজন ডাকাত এসেছে বলে খবর প্রচার করে দেয়। ছুটে আসে বাড়ির কর্তা মহেন্দ্র উকিল । তারপর নলিনীকান্ত সবার কাছে বিনীত মার্জনা চেয়ে রওনা হল প্রকৃত শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। কি›তু শ্বশুর মহেন্দ্রঘোষ জামাতার বেশভুষা , লাঠিবন্দুক, আর পৌরুষালি চেহারা দেখে ডাকাত ভেবে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বিতাড়িত করে দেয়। মহেন্দ্রবাবু দাড়োয়ানকে হুকুুম দেয়  -‘মারকে নিকাল দেও,গর্দান পাকড়ে নিকাল দেও’
নলিনীকান্তের পৌরুষালি অবয়ব গঠনের নিমিত্তে  নিয়মিত ব্যায়াম, কুঞ্জবালার স্বামী চিনতে না পারা, মহেন্দ্রঘোষের জামাতা চিনতে ভুল করা, এসবগুলোই পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটু অস্বাভাবিক ঘটনা,যা সাধারণত হওয়ার কথা নয়,এমন ঘটনাই ঘটল। কিন্তু ঘটনার স্বাভাবিকতা অথবা অস্বাভাবিকতা এ দুটো বিষয়ের চেয়েও গুরুত্ব বলবান জামাতাকে নিয়ে  যে কর্মকাণ্ড তার উপস্থাপন স্টাইল ও কাহিনির একটি রোমাঞ্চকর রসঘন, কৌতুকউদ্দীপক ও হাস্যকর পরিবেশ নির্মাণ-এ বিষয়ে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখনী যাদুর মতো কাজ করে এবং পাঠককে সম্মোহিত করার মত একটি ব্যাপক প্রলুব্ধময় কাহিনির মায়াজালে  আমরা রোমাঞ্চিত হতে থাকি। তবে লেখকের সর্তক দৃষ্টি সব সময় জীবন ঘনিষ্টতার দিকে।
৩.‘বিবাহের বিজ্ঞাপন’ একটি অসাধারণ গল্প। ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ কথাটি বহুল পরিচিত একটি প্রবাদবাক্য যা এই গল্পের নায়কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সতের বছর বয়সের সুন্দরী কন্যার ‘কায়স্থ পাত্র আবশ্যক’ এ রকম একটি বিবাহের বিজ্ঞাপন পেয়ে আবাল্যবিবাহিত রাম অওতারে মনে মনে বিবাহের রোমাঞ্চ লাগে। রাম অওতার মিথ্যা তথ্য দিয়ে লালা মূরলীধর লাল এর নিকট চিঠি দিয়ে একটি ফটোগ্রাফ প্রার্থনা করে। ফিরতি চিঠিতে ফটোগ্রাফ পেয়ে রাম অওতার চূড়ান্ত বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। সোনার ঘড়ি, সোনার চেন, হীরার আংটি, উন্নতমানের আতর লাগিয়ে তারপর খরচ বাবদ দুইশত টাকা এ সমস্ত ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ পূর্বক আবাল্যবিবাহিত রাম অওতার নিজেকে যোগ্য বর হিসেবে সাজিয়ে তুলে। রেশমী চাপকানসহ জরীর কাজ করা চুপি পরিধান করল। তারপর পাত্রীর আলয় কেদারঘাটে রোমঞ্চকর যাত্রা করল। কিন্তু রাম অওতার কাশীতে গিয়ে গুন্ডা মহাদেও মিশ্র ও কাহ্নাইলালের হাতে পড়ল। তারা রাম অওতারকে এক পেয়ালা ভাং ধুতরার রস মিশ্রিত সিদ্ধি দ্বারা আপ্যাায়ন করাল। রাম অওতার যথারীতি নেশায় অচেতন হয়ে পড়ল। তারপর তার সবর্স্ব লুট হয়ে যায়। এমনকি পরিধেয় পোষাক পর্যন্তও খুলে রাখে। এবং অজ্ঞান অবস্থায় মানমন্দিরের বারান্দায় রেখে আসে। পরদিন খবর প্রচার হল যে, রাম অওতার সংসার ধনসম্পত্তি, পরিবার পরিজন ত্যাগ করে কাশীতে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছে। কিন্তু মাতা সন্ধান পেয়ে তাকে গৃহে ফিরিয়ে এনেছে। এরপর রাম অওতারের ধার্মিক খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।
৪.‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পটি নিবিড় কল্পনায় আচ্ছাদিত হয়েও শিল্পসৌন্দর্যে উত্তীর্ণ। নায়ক ক্ষেত্রমোহনের বয়স চল্লিশ, বিবাহিত জীবনের বয়স আঠার কিন্তু এখন পর্যন্তও নিঃসন্তান। তাছাড়া দাম্পত্য জীবনটা স্ত্রীর রুদ্রমূর্তিতে বিষিয়ে উঠেছে। স্ত্রী রসময়ী স্বামীর সাথে ঝগড়া করে অভিমান করে বাবার বাড়ি চলে যায়। আর এ সুযোগে ক্ষেত্রমোহন অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে ফেলে। খবর পেয়ে রসময়ী তার বোন বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে কন্যার পিতৃালয়ে চড়াও  হয় এবং গৃহিণীকে ঝাটাপেটা করে আসে। এতে বিবাহ ভেস্তে যায়। ক্ষেত্রমোহনও রসময়ীর মৃত্যুর পর বিবাহ করবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর অন্য দিকে রসময়ীও ক্ষেত্রমোহনের বিবাহের বয়স নিঃশেষ হলে ইহজগত ত্যাগ করার ইচ্ছে পোষণ করে। কিন্তু রসময়ীর ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। হঠাৎ রসময়ী মৃত্যবরণ করে। ছয় মাস পর আপদ বিদায় ভেবে ক্ষেত্রমোহন পুনরায় বিয়ের আয়োজন করলে পরপর দুটি ভৌতিক চিঠি আসে। চিঠির কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করতে চাই “আমি মরিআছি বটে কিন্তু তাই বলিয়া তুমি নিস্কিৃতি পাইআছ তাহা মোনে করিও না। বাড়ির সনমুখে যে বটগাচ আছে তাতেই আমি আজ কাল বাস করিতেছি। তোমার খাটের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াই। এক এক বার ইচ্ছা করে গলাটা টিপিয়া দিয়া তোমাকে আমার সঙ্গি করি…….. বিবাহ করিও না, করিলে তোমার নলাটে অসেস দুগগতি আছে। ” রসমই।
ফলে ক্ষেত্রমোহন ভীষণ বিপদে পড়লেন। সব রকমের আলোচনা জল্পনা-কল্পনা শেষে চিঠির রহস্য উদ্ধার হল। তল্লাশীর পর ক্ষেত্রমোহনের শ্যালিকা বিনোদিনীর বাক্স হতে এক বাণ্ডিল চিঠি এবং ঠিকানা সম্বলিত কিছু সাদা খাম বের হল। এভাবে সমস্ত ঘটনা ক্ষেত্রমোহনের নিকট পরিস্কার হয়ে গেল। স্বামীর ভবিষ্যৎ আচরণ সমন্ধে রসময়ীর দূরদৃষ্টি এ গল্পের মূখ্যবিষয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যে কাল্পনিকতার বাতাবরণে গল্পের কাহিনি সংযুক্ত করেছেন, তাতে অভিনব হাস্যরস সৃষ্টির উপাদান নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং মানব জীবনের জীবনসত্যের একটি বিশেষ অনুষঙ্গ স্পন্দিত হয়েছে।
৫.‘খোকার কাণ্ড’ গল্পে স্বামী-স্ত্রীর ধর্ম বিশ্বাসের বিরোধকে কেন্দ্র করে হাস্যরস ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। হরসুন্দরবাবু আর পঙ্কজিনী এই দম্পত্তি এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। হরসুন্দরবাবু বে-সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। সে বিয়ের দু-তিন বছরের মধ্যে ব্রাক্ষধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। বিয়ের সময়ে পঙ্কজিনী গোড়া হিন্দু ছিল, এখনও ভেতরে ভেতরে তাই আছে, হঠাৎ হরসুন্দরবাবু ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন নামী দামী ডাক্তারের চিকিৎসায়ও কোন উপকার হচ্ছে না। তখন পঙ্কজিনীর সখী শরৎ হরিমোহন ঠাকুরের তেলপড়া ও বিল্বপত্র এনে গোপনে স্বামীর বুকে ব্যবহার করতে থাকে এবং বাবা ষণ্ডেশ্বরের কাছে পুজা মানত করে। তারপর যে কারণেই হোক হরসুন্দরবাবু সুস্থ্য হয়ে যায়। এবার পঙ্কজিনীর পুজা দেবার পালা। এই সময়ে হরসুন্দরবাবুর চারদিনের কলেজ ছুটি হয় এবং সংকীর্তনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে পঙ্কজিনীও তার মানতের কাজ এ সুযোগে সম্পূর্ণ করতে সচেষ্ট হয় এবং যথারীতি শরতের সাথে বাবা ষণ্ডেশ্বরের পুজা শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরছিল। পথিমধ্যে ট্রেনে কাকতালীয়ভাবে হরসুন্দরবাবু ও  পঙ্কজিনী একই কামরায়। পঙ্কজিনী খোকাসহ চাদরে ঢাকা, হঠাৎ শিশুটি চিৎকার করে উঠল ‘বাবা’। এভাবে খোকার জন্য পঙ্কজিনী হরসুন্দরের কাছে ধরা পড়ে যায়। ধর্মবন্ধুদের সামনে হরসুন্দরের মাথা কাটা গেল। হরসুন্দর দেখল তার স্ত্রীর পরিধানে শাড়ি. কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, গলায় সিন্দুর ও চন্দনলিপ্ত ফুলের মালা। আঁচল থেকে কতকগুলো চন্দনমাখা ফুল ও বেলপাতা গাড়ীর মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে। তৎকালনি ব্রাহ্ম এবং হিন্দু সমাজের বিরোধ লেখক এ গল্পে একটি নিখুঁত হাস্যপরিহাস এর মাধ্যমে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ধর্মীয় বিশ্বাস বা অবিশ্বাস এ গল্পের মূল থিম হলেও পঙ্কজিনী শরৎ ও খোকার নাটকীয় ও কৌতুকোদ্দীপক কর্মকাণ্ডের শৈল্পিক উপস্থাপন এ গল্পটিকে একটি ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে।
৬.জীবনের স্বাভাবিকতাকে সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিবিধানের আওতায় নিয়ন্ত্রণের ফলে যে অস্বাভাবিকতার উদ্ভব হয় তারই কাহিনি ‘নিষিদ্ধ ফল’ গল্পে শৈল্পিক ছোঁয়ায় ঋৃদ্ধ হয়েছে। ভবানীপুরের রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার মিত্র প্রচুর সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি ও নীতি-নৈতিকতায় অতলুনীয়। তিনি বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথার বিরোধী। তিনি সামাজিক সমস্যা সমাধান’ বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন। রায় বাহাদুরের একমাত্র পুত্র হেমেন্তকুমার বি এ পড়ছে। তিনি দুর্গাচরণবাবুর বার বছরের মেয়েকে এক শর্তে পূত্রবধূ করতে রাজী হলেন যে মেয়ের বয়স ষোল এবং ছেলের বয়স ছাব্বিশ বৎসরের পূর্বে তাদের মিলন হওয়া চলবে না। এই শর্ত অনুযায়ী এক ফাল্গুন মাসে তাদের বিয়ে সুসম্পন্ন হল। হেমেন্তকুমার বহির্মহলে নির্বাসিত, শুধু দিনে তিন বেলা খাবার গ্রহণের সময় অন্তঃমহলে প্রবেশের অনুমতি পায় কিন্তু সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। তাই হেমেন্তকুমার নববধূর বিরহজ্বরে আক্রান্ত। ঝি কে ঘুষ দিয়ে হাত করে দুজনের মধ্যে পত্রবিনিময় হতে থাকল। পড়শুনা বলতে এখন হেমেন্তকুমারের বিরহমূলক কবিতা রচনা ও পত্র লেখা। ফলে বি ত্র পরীক্ষার ফলাফলে কোথাও হেমন্তকুমার নাম পাওয়া যায় নি। ফলে রায় বাহাদুর ক্ষিপ্ত হয়ে হেমেন্তকুমারকে মেসে পাঠিয়ে দিল। ফলে হেমেন্তকুমারের বিরহযন্ত্রণা আরও বেড়ে গেল। বাড়ির ঝির সহায়তায় রাত্রিকালে হেমেন্তকুমার নববধূর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ফলস্বরুপ একদিন দুপুর রাতে চোর ধরতে গিয়ে রায়বাহাদুর আবিষ্কার করল যে পুত্রবধূর শয়নকক্ষের জানালায় দড়ি ঝুলছে। চোর দড়ি বেয়ে জানালা দিয়ে রুমে ঢুকেছে-এই ভেবে রায় বাহাদুর বন্দুক হাতে রুমের সামনে দাঁড়ালে ঝি কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলে দেয়। তারপর রায়বাহাদুর দেখল- “মেঝের উপর তাহার পুত্রবধূ মূর্”িছত অবস্থায় পড়িয়া, চোর পালঙের উপর লেপ মুড়ি দিয়া আছে।”পরদিন রায় বাহাদুর ‘সামাজিক সমস্যার সমাধান’ গ্রন্থে ‘চতুর্বিংশতি’ কথটি কোটে ‘দ্বাবিংশতি এবং ‘ষোড়শ’ কথটি কেটে ‘চতুর্দ্দশ’ করে দিলেন। এ গল্পে প্রভাতকুমার মুখেপাধ্যায়ের শিল্পসংযম বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় শিল্প রসিক ও জীবন রসিক হওয়া সত্ত্বেও শৈল্পিক সংযম সীমার মধ্যে জীবনসত্য উদঘাটন ও উপস্থাপনে তার কোমল শৈল্পিক সত্ত্বার নিরন্তর প্রয়াস নদীর স্রোতধারার মত বহমান। পাঠক সমাজকে জীবনসত্যের রসময় কাহিনির বিন্যাস ও বুননে সর্বদা আমোদিত রাখতে তার লেখনী ও উপস্থাপন শক্তি যাদুর মত কাজ করে।
৭.‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র বিমলচন্দ্র গাঙ্গুলী, সে মহেশপুর গ্রামের ডাকঘরের সাব পোস্টমাস্টার পদ নিয়োজিত। নিজের নামে কোন প্রেম পত্র না আসলেও সে প্রেমপত্র পাঠে অভ্যস্থ। পুরুষের হস্তাক্ষরে স্ত্রীলোকের ঠিকানা সম্বলিত চিঠি বিমল সবসময় আলাদা করে রাখে। চিঠির মুখ খুলে পাঠ করার পর আবার ঠিকানা মোতাবেক পাঠিয়ে দেয়। এভাবে বিমল পোস্ট মাস্টার হওয়ার সুবাদে সহস্রাধিক প্রেমপত্র পাঠ করেছে। বিমল এভাবে একটি চিঠি পাঠ করে নিজেই বিমোহিত হয়ে যায়। চিঠির কিছু অংশ নিম্বরূপ : ‘তুমি পূর্ব পরামর্শ মত, রাত্রি ঠিক বরোটার সময় তোমাদের বাড়ীর পশ্চিমে সেই শিব মন্দিরের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইবে-আমি মন্দিরের পার্শ্বস্থ সেই বটবৃক্ষের ছায়ায় লুকাইয়া থাকিব এবং তুমি আসা মাত্র তোমাকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় লইয়া আসিব। ….সোমবার দিন আমি যথাশাস্ত্র তোমার পাণি গ্রহণ করিব।’
ইতি
তোমার (মন) চোর
চিঠির প্রাপকের নাম চারুশীলা। বিমল এই চিঠিটি পাঠ করার পর প্রেমনাটকের নায়কের ভূমিকায় পাঠ করার অভিপ্রায় জাগে এবং অন্যের নায়িকা অপহরণ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। ফলে প্রহারের দরুণ পরদিন প্রভাতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ডাকঘরের বারান্দায় বিমলকে পাওয়া যায়। তারপর বিমলের দুষ্ট বুদ্ধির কৌশলে সর্বত্র পোস্ট অফিসে ডাকাতির খবর প্রচারিত হল এবং সরকারের অর্থরক্ষা প্রচেষ্টার পুরস্কার হিসেবে বিমলের ইন্সপেকটর পদে পদোন্নতি ঘটল। সামাজিক ও পারিপার্শি¦ক অবস্থার প্রেক্ষিতে বিমল চরিত্রের আচরণ ও কর্ম কাণ্ডের উপস্থাপনরীতি ও পদ্ধতি শুধুমাত্র পাঠককে হাসির উপাদান সরবরাহ করে না, লেখকের শৈল্পিক ও হাস্যরসিক সত্ত্বার একটি ভিন্ন মাত্রা সংযুক্ত করে।
বাংলা ছোট গল্পে রবীন্দ্রনাথের মত প্রভাতকুমারও উত্তরসূরিদের প্রেরণার অফুরন্ত উৎস।অজস্রতায় ও বৈচিত্র্যে, দৃষ্টি ও সৃষ্টির অনায়াস ও স্বাতন্ত্র্যময় ভঙ্গিতে,সর্বোপরি প্রসাদগুণান্বিত রচনাশিল্পে  প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এখনও অনন্য ও অদ্বিতীয়। তাঁর গল্পগুলোর বহিরাবরণে হাসির উপাদান সমন্বয়ে এক অনন্যমাত্রা সংযুক্ত হলেও  হাসির অন্তরালে  মানবসত্য তথা জীবনসত্যের অফুরন্ত উৎস আমাদেরকে সবসময়  এক অভূতপূর্ব, রোমাঞ্চিত অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। তাই তাঁর গল্পগুলো  শুধু হাসির গল্প নয়, সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত মানব জীবনসত্যের এক অসাধারণ শৈল্পিক বুনন।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

সুত্র: প্রতিভা, বর্ষ ॥ পাঁচ, সংখ্যা ॥ প্রথম ॥ জানুয়ারি ২০১৪ খিস্টাব্দ