গুঞ্জরিয়া আসে অলি ।। সৈকত আরেফিন

গুঞ্জরিয়া আসে অলি
সৈকত আরেফিন

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে যেদিন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জীবনাবসান ঘটে, তার কয়েক মাস পরেই, একই বছর নভেম্বরের ১৩ তারিখে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ঘোষিত হয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অল্পের জন্য বাংলা সাহিত্যের এপর্যন্ত একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে অভিনন্দিত করার সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। অবশ্য কাব্যাদর্শের দিক থেকে বিদেশি ও বৈষ্ণব ভাবের ধার করা মুন্সিয়ানা, ভাষার উল্লম্ফন এবং ভাবের দুরবগাহতা যখন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে রবীন্দ্রনাথের বিপ্রতীপে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, বেঁচে থাকলেও তিনি নোবেল বিজয়ীকে অভিনন্দিত করতেন কি না, এই সংশয় অমীমাংসিত থেকে যাবে। তখন সকল সন্দেহ ও সংশয়কে দূরে রেখে আমরা বরং তাঁর মাত্র ৫০ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনকালের দিকে পুনরায় ফিরে তাকাতে পারি। বাংলা সংস্কৃতির পীঠস্থান নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের রাজার দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ও প্রসন্নময়ী দেবীর সপ্তম পুত্রসন্তান হিসেবে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাইয়ে জন্মে যে দ্বিজু একদিন বাংলা সাহিত্যের কবি ও নাট্যকার, সুরকার, গীত-রচয়িতা এবং সংগীতজ্ঞ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তথা ডিএল রায় হয়ে উঠেছিলেন আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করব, সাহিত্য ও সংগীত শিল্প হিসেবে এক না হলেও দ্বিজেন্দ্র-প্রতিভার সঙ্গে তাঁর এই সংগীত-প্রতিভার নিগূঢ় মেলবন্ধনকে উপেক্ষা করা যায় না। দ্বিজেন্দলালের সকল সৃষ্টির মূলে সংগীত-প্রতিভার প্ররোচনাকে স্বীকার করতেই হয়। বাল্যকালে যখন তাঁর বয়স মাত্র ৪ কিংবা ৫, তখন পিতার হারমোনিয়াম বাজিয়ে দ্বিজেন্দ্রলালের যে সংগীতজীবন সূচিত হয়েছিল; ‘ক্যায়সে কায়টে পেয়ালা মে নাগরী’ গানে পিতাকে মুগ্ধ করে সেই সংগীত-প্রতিভা পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই গীতিকবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শৈশবে রচিত সেইসব গীতিকবিতার অনভিজ্ঞ সারল্য সত্ত্বেও আকাশের তারকাকে সম্বোধন করে লেখা-‘কে বল সৃজিল মোরে তোমারে/কে বল সৃজিয়া, দিল রে রাখিয়া/সুদূরে অম্বরে।’-এর মত তন্ময় জিজ্ঞাসাকে প্রচিহ্নিত করি তখন আমরাও শিশুর কৃতিত্বে তন্ময় না হয়ে পারি না। আবার বড়দাদা জ্ঞানেন্দ্রলালের আদেশে ৮/৯ বছরের বালক যখন লেখেন-‘গভীর নিশীথকালে নিরজনে বসিয়া/কে তোমরা প্রতিনিশি রহ নভ শোভিয়া’-তখন বালক দ্বিজেন্দ্রলালের কবিত্ব-শক্তির বর্ধিষ্ণুপ্রবণতা আমাদের আশ্বস্ত করে। যদিও দ্বিজেন্দ্রলাল নিজে এসব শৈশব-কীর্তিকে তেমন মূল্য দিতে চান নি।


‘নব্য ভারত’ নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর একটি কবিতা। দ্বিজেন্দ্রলাল তখন পিতার নির্দেশে দেওঘরে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য অবস্থান করছিলেন। ‘দেওঘরে সন্ধ্যা’ নামের সেই কবিতাটি বলা বাহুল্য, তাঁর মুদ্রিত প্রথম কবিতা। এরপর যখন ৫ মার্চ ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে আর্য্যগাথা (১ম ভাগ) নামের প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তখনও দ্বিজেন্দ্রলাল এমএ পরীক্ষা দেন নি। ঊনিশ বছরের যুবক কবি আর্য্যগাথা সম্পর্কে নাট্যমন্দির (১৩১৭, শ্রাবণ)-এ নিজে জানাচ্ছেন-‘১২ বৎসর বয়ঃক্রম হইতে আমি গান রচনা করিতাম। ১২ বৎসর হইতে ১৭ বৎসর পর্যন্ত রচিত আমার গীতগুলি ক্রমে আর্য্যগাথা নামক গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হয়।’ সেই যুবক বয়সে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রথম কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে এমন কিছু কথা বলতে পেরেছিলেন, যাতে আমরা এখনও প্রণোদিত হতে পারি। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছিলেন-‘যাঁহারা একমাত্র মনুষ্যগীতকেই গীত মনে করেন, আর্য্যগাথা তাঁহাদিগের জন্য রচিত হয় নাই, এবং তাঁহাদিগের আদর প্রত্যাশা করে না। যদি কেহ প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্যে ও লাবণ্যে কখন কখন বিমুগ্ধ হইয়া থাকেন, যদি কেহ প্রকৃতিকে দেখিতে দেখিতে কখন কখন প্রকৃতি-রচয়িতার অনন্ত মহিমায় স্তব্ধ হইয়া থাকেন, যদি কেহ শোক-জরাসঙ্কুল জগতে দুঃখাবসন্ন হইয়া কখন নীরবে অশ্রুবারি বিসর্জন করেন, যদি কাহারও অধঃপতিতা হতভাগিনী দুঃখিনী মাতৃভূমির নিমিত্ত নেত্রপ্রান্ত কখন সিক্ত হইয়া থাকে, আর্য্যগাথা তাঁহারই আদর চাহে।’ সুনির্দিষ্ট লোকের সমাদর প্রত্যাশা করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর কাব্যজীবনের সম্ভাবনার দিকটিকেও মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন এ বলে যদি-‘আদর পায়, আবার নূতন গীত শুনাইবে। না পায়, যথার্থই হতাশ হইবে।’
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে তখন হতাশ হতে হয় নি। যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন একসময় বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল সেই রবীন্দ্রনাথই ১৩০১ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকায় আর্য্যগাথা কাব্যটির একটি দীর্ঘ আলোচনা লিখে কবির প্রত্যাশিত সম্ভাবনাকে উস্কে দেন। তিনি লেখেন যে, কবিতার কথা সবটুকু না হলেও অনেকখানি, কিন্তু গানে সুরই প্রধান। কাব্যকে অন্তরের মধ্যে ধ্বনিত করে তুলবার জন্যে এদেশে সংগীতের অবতারণা হয়েছিল বলে আর্য্যগাথার আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ আরও লেখেন-‘…গ্রন্থখানিতে উভয় শ্রেণীর গানই দেখা যায়। ইহার মধ্যে কতকগুলি গান আছে, যাহা সুখপাঠ্য নহে, যাহার ছন্দ ও ভাববিন্যাস সুরতালের অপেক্ষা রাখে, সেগুলি সাহিত্য সমালোচকের অধিকার বহির্ভূত। আর কতকগুলি গান আছে, যাহা কাব্য হিসাবে অনেকটা সম্পূর্ণ যাহা পাঠমাত্রেই হৃদয়ে ভাবের উদ্রেক ও সৌন্দর্য সঞ্চার করে। যদিচ সে গানগুলির মাধুর্যও সম্ভবত সুরসংযোগে অধিকতর পরিস্ফুটতা, গভীরতা এবং নতুনত্ব লাভ করিতে পারে। তথাপি ভালো এনগ্রোভিং হইতে তাহার আদর্শ অয়েল পেইন্টিংয়ের সৌন্দর্য যেমন অনেকটা অনুমান করিয়া লওয়া যায়, তেমনি কেবলমাত্র সেই সকল কবিতা হইতে গানের সমগ্র মাধুর্য আমরা মনে মনে পূরণ করিয়া লইতে পারি।’ ‘একবার দেখে যাও, দেখে যাও কত দুখে যাপি দিবানিশি’ কীর্তনটির প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেন-‘এমন বেদনায় পরিপূর্ণ, অনুরাগে অনুনয়ে, পরিপ্লুত গান অল্পই দেখা যায়।’ কেননা পড়তে পড়তে এর আকুতিপূর্ণ সংগীতটি যেন আমাদের কল্পনায় ধ্বনিত হতে থাকে। সম্ভবত যে সুরে এই গান বাঁধা হয়েছে, তা আমাদের কল্পনার আদর্শের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। একটিমাত্র স্থায়ীভাবকে অবলম্বন করে দশ স্তবকে সমাপ্ত দীর্ঘ সংগীতটি আত্মপ্রকাশ করে নি বলে এর উপযুক্ত রাগিণীটি সহজে প্রত্যাশাও করা যায় না। সুর না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ একে গানই বলতে চান এজন্যে যে, এটি আমাদের মনের মধ্যে গানের একটি বাসনাকে সংগুপ্ত রাখে।
রবীন্দ্রনাথের এই প্রশস্তি দ্বিজেন্দ্রলালকে কতটা প্রণোদিত করতে পেরেছিল, এই প্রশ্নকে ঊহ্য রেখে আমরা আবারও তাঁর জীবনের দিকেই তাকাব। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একসময় জেদের বশে সাহেবি ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। বাবুর বদলে মিস্টার বললেই তিনি খুশি হতেন। এই সাহেবিয়ানার জন্যই ভবিষ্যতে তিনি ডিএল রায় নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। যদিও ময়ুরপুচ্ছধারী বাঙালি সাহেবদের হাসির গানে তীব্র কটাক্ষ করে নিজেই সাহেবিয়ানা থেকে যখন সরে এলেন, ততদিনে দ্বিজেন্দলাল রায় ডিএল রায়ে একীভূত হয়ে আমাদের সহজন হয়ে গেছেন।


আমাদের ডিএল রায়, পরবর্তীকালে বিশ শতকের ষাটের দশকে যখন পূর্ববঙ্গের মানুষ জেগে উঠল স্বাধিকার আন্দোলনে তখন আরও বেশি করে আমাদের হয়ে উঠলেন। ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার আমার দেশ’ বলে যখন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আমরা বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধটি করছি দ্বিজেন্দ্রলাল তখনও আমাদের অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে থাকলেন। পাশ্চাত্য সংগীতকে রসসম্মতভাবে বাংলা কাব্যসংগীতে অন্তর্ভুত করেছিলেন তিনি। বস্তুত, দেশাত্মবোধক গানের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিমের এই সমন্বয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছিল। বাংলা সংগীতের সুরযোজনার ক্ষেত্রে তাঁর ভঙ্গিটি বিশেষ করে সুরের উত্থান ও পতনের ক্রমধারা একটি নতুন ধারণা তৈরি করেছিল। দেশাত্মবোধ, প্রেম ও হাস্যরস নিয়ে নির্মিত দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতে বাণীর বৈভব হয়তো তাঁর সমকালীন আরেক মহান সংগীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনীয় নয়; যেখানে সুর ও বাণীর ভাব-বিহ্বলতায় রবীন্দ্রনাথের গান অনন্য হয়ে উঠেছে, দ্বিজেন্দ্রলালের গান সেভাবে বাণী ও সুরের মিথস্ক্রিয়ায় যূথবদ্ধ হতে না পারলেও সুরের নির্মিতিতে তাঁর স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতে হবে। সুরকার হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে আমরা সেই স্থান দিতে চাই যেখানে রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল পরস্পরের সমীপবর্তী। সুরের অপূর্ণ জায়গাটিকে বাণী দিয়ে পূর্ণ করে অগ্রবর্তী ধারাকে পরিহার করে তাঁরা দুজনেই এমন সংগীত রচনা ও সুরযোজনা করলেন, বাংলা গান সৃষ্টি স্বাতন্ত্র্যে অনপেক্ষ বৈশিষ্ট্যে উত্তীর্ণ হলো।
১৮৮৪ থেকে ১৮৮৬ পর্যন্ত মাত্র তিন বছরের বিলেতবাস দ্বিজেন্দ্রলালের রায়ের সংগীতজীবনের ভিতটাকে বলা যায় শক্তপোক্ত করে দিয়েছিল।। এই সময়ে আমরা দেখি, তাঁর বাল্য ও কৈশোরের খেয়ালিপনা, মাঝে মাঝে নির্জন স্থানে একাকী থাকার বাসনা, জেদ ও আত্মমর্যাদাজ্ঞান ও আত্মস্বাতন্ত্র্য, অকপটতা, সংযম, যুক্তি-তর্ক উৎসাহ, প্রকৃতিপ্রেম ও দেশানুরাগ আরও ঋদ্ধ ও পরিপুষ্ট হয়েছে। বিলেতি সংগীত-সাধনার আগ্রহ, ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখার প্রয়াস, ইংরেজি কাব্য-নাটক পাঠ ও রঙ্গমঞ্চে নাটক দেখার অত্যুৎসাহ এই সময়েই তাঁর মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে উঠতে ইংরেজ সমাজ ও রীতিনীতির সঙ্গে আমাদের সমাজ ও রীতিনীতির তুলনা করার প্রবণতাও তাঁর মধ্যে তৈরি হয়। এবং এ কথাও বলা যায়, তিন বছরের এই বিলেতবাসের অভিজ্ঞতা তাঁকে পাশ্চাত্য সুরকে সাফল্যের সঙ্গে বাংলা গানে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল। সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুর কিংবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসুরী হলেও দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁদেরকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন অভিজ্ঞতালব্ধ দক্ষতায়। বিলেতবাসের শুরুতে বিলেতি সুর অশ্রাব্য মনে হলেও যখন তিনি সেই সুরের অন্তর্গত মূর্ছনাকে উপলব্ধি করলেন, তখন তাকে আত্মস্থ করে বাংলা গানের সুরের সঙ্গে অন্তর্বিলীন করে দিলেন। তাই এই সুর তাঁর গানে অবাঞ্ছিত বন্ধন হলো না, বরং মুক্তি পেল যৌথতায়, আরও প্রাণবন্ত হয়ে সুরের আকাশটিকে আন্তর্জাতিক করে দিল।


ভারতবর্ষীয় ও পাশ্চাত্য সুরভাবনাকে বিশেষ করে ইংরেজি সংগীতের সঙ্গে ভারতের সংগীতের সুরের অনৈক্য ও মেলবন্ধন বিষয়ে রচিত ‘ইংরেজি ও হিন্দু সংগীত’ নামক একটি প্রবন্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আমাদের জানিয়েছেন- ‘ইংরেজি সংগীতে প্রতি গানের সুর নিরাশ্রয়।…তাহারা কোন নির্দিষ্ট ভিত্তি হইতে উঠে না বা কোন নির্দিষ্ট স্থানে শেষ হয় না।…ধূমকেতুর মত কোথা হইতে আসিয়া কোথায় চলিয়া যায়, তাহার ঠিকানা নাই।’ আর হিন্দু অর্থাৎ ভারততবর্ষীয় সংগীতে ‘আগে যেন একটা স্বরের সমুদ্র রচনা করিয়া লইতে হয়, রাগ-রাগিণীগুলি যেন সেই সমুদ্রের বক্ষে ঊর্মিমালার ন্যায় তাহা হইতেই উঠে তাহাতেই মিলাইয়া যায়।’ বিলেতি গানের সুরপ্রসঙ্গে তিনি বলেন-‘যেন হাউইয়ের মত একেবারে ঊর্ধ্বে উঠিয়া চলিয়া যায় এবং সেখানে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ রাশি প্রক্ষিপ্ত করিয়া শূন্যমার্গেই নিভিয়া যায়।’ রাগসংগীতের ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য কোরাসভঙ্গিমা ও গায়নকলা প্রয়োগ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলা গানে আরেকটি মাত্রা যোগ করেন। ‘ধাও ধাও সমর ক্ষেত্রে’-এর মত গানে সামরিক বাহিনির মার্চসংগীতের সুর সংযোজনা করে এক্ষত্রে তিনি পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সংগীতজ্ঞ সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের কাছে খেয়াল ও টপ্পার যে গীতকরণকৌশল আয়ত্ত করেছিলেন, নিজের গানে দ্বিজেন্দ্রলাল তা প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন যথার্থভাবেই। বস্তুত, রাগসুরকে তাঁর সংগীত রচনার উৎস মনে করা হলেও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রথাগত রাগসুরের অনুবর্তনকে এড়িয়ে গিয়ে পরিপ্রেক্ষিত থেকেই নির্মাণ করেছেন নতুন সুর। এমনকি ঢপ খেয়াল-আঙ্গিকের সুর রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা গানে তিনিই যথাযোগ্যভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। কোরাসগানের যে প্রাণশক্তি ইউরোপ থেকে গ্রহণ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলা গানে অন্তর্ভুত করেছিলেন, যাতে বাংলা গান বিলেতি সুরের ‘মুভমেন্ট’কে গ্রহণ করে স্বরগ্রামের পরিধিকে বিস্তৃত করতে পেরেছিল।


ডিএল রায় পাশ্চাত্য সংগীতভঙ্গিটিকে বাংলা হাসির গানে যুক্ত করে বাংলা গানে যে উন্মুক্ত সুরবৈশিষ্ট্য দিলেন, বাঙালি স্নাত হল সেই সুরের আবাহনে। জবভড়ৎসবফ ঐরহফড়ড়ং-এর মত-‘আমাদের ভাষা একটু য়ঁধরহঃ/ধং ুড়ঁ ংবব,/এ নয় ঊহমষরংয কি ইবহমধষর/করি ঊহমষরংয ও ইবহমধষরর/ঈড়হাবৎংধঃরড়হ এ ঁংব;/কিন্তু একটিও ঠিক কইতে পারি/রভ ুড়ঁ ঃযরহশ/ তা‘লে ুড়ঁ ধৎব ধহ ধভিঁষ মড়ড়ংব.’-এভাবে ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল হাসির গানে পাশ্চাত্য ধাঁচের ছেঁড়া ছেঁড়া সুরবিন্যাস করলেন। তাঁর রচনায় হিউমার ও উইটে ভরা বাংলা গান যে চারিত্রবৈশিষ্ট্য পেল, জাতির মর্মে আত্মসমালোচনার ধারাটিও তাতে পুষ্ট হয়ে উঠেছিল।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-‘শুদ্ধমাত্র অমিশ্র হাস্য ফেনরাশির মত লঘু এবং অগভীর।’ সে হাসি হয়তো বিষয়ের উপরিতলের অস্থায়ী উজ্জ্বল বর্ণপাত মাত্র। হাসির সঙ্গে চিন্তা এবং ভাবের বিকাশ থাকলেই কেবল তার একটা স্থায়ী সমাদর প্রাপ্তি ঘটে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর হাসির গানগুলি একত্র করে হাসির গান (১৯০০) নামে যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন, এতে যথার্থ অর্থেই তিনি চিন্তা ও ভাবের সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলেন। এই গানগুলিতে আবারও রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-‘হাস্য এবং অশ্রুরেখা, কৌতুক এবং কল্পনা, উপরিতলের ফেনপুঞ্জ এবং নিম্নতলের গভীরতা একত্র প্রকাশ পাইয়াছে। তাহাই তাঁহার কবিত্বের যথার্থ পরিচয়।’ ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক, দার্শনিক, আহার ও পানীয় বিষয়ক বিবিধ পর্যায়ে বিন্যস্ত গানগুলিতে ডিএল রায়ের নৈপুণ্য রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণের অন্তর্চেতনারই ইঙ্গিতবাহী। ‘রাম-বনবাস’ গানে রামের বনবাসের প্রয়োজন হলে সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে আরও নেবে একজোড়া পাশা ও দুইজোড়া তাস। বঙ্কিমের উপন্যাসও প্রয়োজন পড়বে। আর-‘ও রাম দেখিস তোর ঐ বাপ মাকে/চিঠি লিখিস প্রতি ডাকে/ আর মাঝে মাঝে রাত্রিকালে/(ওরে) পোটেটো চপ খাস।’ অথবা ‘কৃষ্ণ-রাধিকা সংবাদ’-এ পৌরাণিকতা ছাড়াই আধুনিক তরুণ-তরুণীর মান অভিমানের কথোপকথনে তৈরি হয়েছে হাস্যরস-‘কৃষ্ণ বলে এমন বর্ণ দেখি নি ত কভু/ আর রাধা বলে/ হাঁ আজ সাবান মাখি নি ত তবু-/ নইলে আরও শাদা।’ শুধু বিদ্রুপ ও আঘাত নয়, অনুকম্পা ও সমবেদনাও ডিএল রায়ের গানের অন্তর্গূঢ় চেতনার সঙ্গে পৃক্ত হয়েছে। ‘প্রাণ রাখিতে সদাই যে প্রাণান্ত’, ‘পান্ত আনতে লবণ ফুরায় লবণ আনতে পান্ত’, বা ‘বিয়ে করেই পুত্র-কন্যা আসে যেন প্রবল বন্যা’ প্রভৃতি গানে দারিদ্র্যপীড়িত বাঙালিজীবনকেই তিনি আমূল তুলে আনেন। ‘চাষার বিরহ’ গানে প্রবাসী চাষি স্বামীর বেদনা এবং রাতে স্বপ্নে স্ত্রীকে দেখে ‘আশ্বিনের কি চৈত্তির ঝড়ে কলাগাছের মত’ তার ধড়াস করে পড়ে যাওয়ার শব্দে তখন কেবল হাসি পায় না, বিড়ম্বিত জীবনের এই তাড়না ও যাতনার দৃশ্য নির্মাণ করে নান্দনিক ব্যঙ্গের মাধ্যমে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিষয়ের নিম্নতলের গভীরতাকেই যেন প্রতিপন্ন করতে পারেন।


দ্বিজেন্দ্রলালের গানভুবন নির্মিত হয়েছে অসংখ্য রাগ ও তালের বিন্যাসে। কবিপুত্র সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের তালিকা থেকে আমরা জানতে পারি-ভৈরবী, ভৈরবী-আশাবরী, ইমন কল্যাণ, খাম্বাজ, ভৈরোঁ, ভীমপলশ্রী, বাহার, নটমল্লার, সিন্ধুড়া, ছায়ানট, বাগেশ্রী, জয়জয়ন্তী, ভূপকল্যাণ, যোগিয়া, দরবারী কানাড়া, কেদারমল্লার, কল্যাণ, ভূপালি, ইমন, সন্ত, লুমখাম্বাজ, সিন্ধুকানাড়া, মিশ্র কেদার, মিশ্র শঙ্করা, পিলু বারোয়োঁ ইত্যাদি রাগের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর রচিত গানে ব্যবহার করেছেন চৌতাল, ত্রিতালি, একতালা, গৎ, ঝাঁপতাল, তেওড়া, আড়াঠেকা, আড়খেমটা, দাদরা ইত্যাদি তাল। কিন্তু দেশি সুরও যে তাঁর হাতে যাদুঘোরমোহতায় আচ্ছন্ন হয়েছে কয়েকটি দেশি সুরের গান উদ্ধৃত করলে তা অনুভববেদ্য হয়ে উঠতে পারে।

ক.
একবার গালভরা মা-ডাকে।
মা বলে ডাক্ মা বলে ডাক্,
মা বলে ডাক মাকে।
ডাক্ এম্নি করে আকাশ, ভুবন
সেই ডাকে যাক ভরে
আর ভায়ে ভায়ে এক হয়ে যাক
যেখানে যে থাকে।


(ঐ) মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সংগীত ভেসে আসে।
কে ডাকে মধুর তানে কাতর প্রাণে ‘আয় চলে আয়’
ওরে আয় চলে আয় আমার পাশে ॥
বলে আয় ছুটে আয় রে ত্বরা হেথা নাই ক
মৃত্যু নাই ক জরা
হেথা বাতাস গীতিগন্ধভরা চিরস্নিগ্ধ মধুমাসে
হেথায় চিরশ্যামল বসুন্ধরা চিরজ্যোৎস্না নীলাকাশে।


আয় রে বসন্ত তোর ও
কিরণ-মাখা পাখা তুলে।
নিয়ে আয় তোর কোকিল পাখির
গানের পাতা গানের ফুলে।

এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এভাবে দেশি সুরের মূর্ছনায় বাঙালিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। দেশগান থেকে শুরু করে হাসির গান ও প্রেমের গানেও রাগ-রাগিণীর অবয়বকে অবিকল রেখে সুর ও তালে যে ওজস্বীতা তিনি নিয়ে এসেছিলেন তাতে বাংলা গান নবতর প্রাণশক্তির সঙ্গে পেয়ে গিয়েছিল তার মহান সংগীতস্রষ্টাদের অন্যতমকে। মূলত গান রচয়িতা ও সুরস্রষ্টা হিসেবেই দ্বিজেন্দ্রলাল ক্রমে অগ্রসর হয়েছিলেন অমরতার পথে। কিন্তু আমাদের এও জানা আছে অমরতা সহজ নয়। একটি জাতির আনন্দ-বেদনার একেবারে গভীরতর মর্মমূলে প্রবেশ করতে পারলেই হয়তো অমরতাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বস্তুত তাঁর গানের যাদুঘোরে বাংলাদেশের মানুষের গভীর প্রাণে জায়গা করে নিয়ে অনশ্বর অস্তিত্ত্বের সীমানায় পৌঁছনোর পথে এগিয়ে গেছেন। অথবা এভাবে বলা যায় আমরা যখন তাঁর-‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা/ ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’-গেয়ে দেশের জন্য জন্য আকুলভাবে গর্বিত হয়ে উঠি তখন কি দ্বিজেন্দ্রলালকেও আমাদের প্রাণের গভীরে অনুভব করি না! যখন জন্মভূমির গাছে গাছে ফুলেরা ফুটে থাকে, বাগানে পাখি ডেকে ওঠে, যখন ভায়ের আদরে, মায়ের স্নেহে ব্যাকুলবিহ্বলতায় গেয়ে উঠি-‘ ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি/ আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’-সম্ভবত তখনই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আমার এবং বংশানুক্রমে আমার সন্তানের বুকের মধ্যে অমরতা লাভ করেন।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সুত্র: প্রতিভা, বর্ষ ॥ পাঁচ, সংখ্যা ॥ প্রথম ॥ জানুয়ারি ২০১৪ খিস্টাব্দ